প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
কল আছে, জল নেই। রাস্তা আছে, আলো নেই। হাসপাতাল আছে, চিকিৎসক নেই।
কান পাতলেই এই ‘নেই-রাজত্ব’-এর কথা শোনা যাবে হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সাঁকরাইল, পাঁচলা, বালি, উত্তর হাওড়া, শিবপুর, মধ্য হাওড়া ও দক্ষিণ হাওড়ার মতো একাধিক বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দাদের মুখে। কান পাতলে তৃণমূলেরই জেলার নেতা-কর্মীদের মুখে শোনা যাচ্ছে আরও একটি কথা— ভোট না এলে ‘দাদা’, অর্থাৎ প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নাকি একটি বারের জন্যও এলাকায় দেখতে পাওয়া যায় না। যা কার্যত মেনেও নিয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। যেমন, খোদ দক্ষিণ হাওড়ার শাখা সংগঠনের এক পদাধিকারী বলছেন, ‘‘দাদার একটাই সমস্যা। ওঁর সঙ্গে আমরাই যোগাযোগ করতে পারি না। কারণ, উনি ফোন ধরেন না।’’
সাধারণ মানুষ ও দলের কর্মীদের কাছে তিনি যে অনেকটাই অধরা, তা বোঝা গিয়েছে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও। হাওড়ার বিদায়ী সাংসদকে প্রশ্ন করতে তাঁকে বার বার ফোন করা হয়েছিল। তিনি ধরেননি। তাই প্রশ্ন লিখে তাঁকে মেসেজ ও মেল পাঠানো হয়। কিন্তু উত্তর আসেনি। শেষে এ বিষয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে আপ্ত সহায়ককে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘দাদা মিডিয়াকে কিছু বলবেন না। এমনটাই জানিয়ে দিয়েছেন। আমার কিছু করার নেই।’’
এক জন সাংসদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে সংবাদমাধ্যমেরই যদি এই হাল হয়, তা হলে তাঁর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কী অবস্থা? যেমন, হাওড়ার সাঁকরাইল ব্লকের সারেঙ্গা এলাকা। ফাল্গুনের এক তপ্ত দুপুরে কলে জল আনতে এসে আঙুরবালা দাস নামে এক অশীতিপর বৃদ্ধা বললেন, ‘‘এমন দিন দেখতে হবে ভাবিনি। আধ ঘণ্টা ধরে কল টিপে এক বালতি জল পাচ্ছি। ও দিকে সব বাড়িতে বাড়িতে ডিপ টিউব (টিউবওয়েল) বসিয়ে জল তুলে বিক্রি করছে। কাকে বলব? নেতা, মন্ত্রী কেউ তো আসে না।’’ শুধু ওই বৃদ্ধা নন, ক্ষোভের আঁচ মিলেছে এই লোকসভা কেন্দ্রের সাঁকরাইল ব্লকের দক্ষিণ সাঁকরাইল, ধূলাগড়, সারেঙ্গা-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে। সকলের একটাই অভিযোগ, সমস্ত ব্লক জুড়ে ভূগর্ভের জলস্তর হুহু করে নামছে। পুলিশ-প্রশাসন থেকে নেতা-মন্ত্রী, সকলেই সব জানেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাসকদলের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদেরা কোনও গা করছেন না।
এই মারাত্মক অভিযোগের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে হাওড়া সদর লোকসভা কেন্দ্রের বাসিন্দাদের অন্যান্য অভিযোগও। এলাকার তৃণমূল কর্মীরাই অভিযোগ করছেন, নলপুর থেকে সারেঙ্গার পথে বাঁধের রাস্তায় আলো নেই। হীরাপুরের শ্মশান গঙ্গার জোয়ারে ভেঙে গেলেও তা নতুন করে তৈরি করা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও সাংসদ তহবিলের অর্থ বরাদ্দ না হওয়ায় নিত্যানন্দ কমিউনিটি হল এবং হাজি এসটি মল্লিক গ্রামীণ হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গ ভাবে তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তাই বালি থেকে পাঁচলা, সর্বত্রই প্রশ্ন উঠেছে, মোহনবাগানের মাঠে যে ভাবে ‘অর্জুন’ খেতাবজয়ী প্রসূনকে দৌড়তে দেখা যেত, নিজের কেন্দ্রে তাঁর সেই দৌড় দেখা যায় না কেন? স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘আসলে উনি তো নিজের দলের মধ্যেও একটি গোষ্ঠীর মধ্যে থাকেন। ওঁর জনসংযোগ বলতে কিচ্ছু নেই। ওঁকে দেখেছি, সাধারণ মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে। উনি ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝেন না।’’ এক সময়ের ময়দান কাঁপানো ফুটবলারকে নিয়ে এমনই মন্তব্য করেছেন হাওড়া জেলার সিপিএম সম্পাদক দিলীপ ঘোষ। অন্য দিকে, বিরোধী দল বিজেপির রাজ্য কমিটির সম্পাদক উমেশ রাই বলেন, ‘‘গত তিন বারের সাংসদ প্রসূনবাবুকে কোথাও তো দেখাই যায় না। শুধুমাত্র ভোটের জন্য সংখ্যালঘু বস্তিতে ঘোরেন। আসলে বালি থেকে পাঁচলা, ওঁর সঙ্গে দলেরই কেউ নেই।’’
দলীয় প্রার্থীর যে জনসংযোগে খামতি আছে, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন দলের সদর জেলা সভাপতি কল্যাণ ঘোষও। তিনি বলেন, ‘‘সাংসদ সব জায়গায় যেতে না পারলেও দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিক হিসাবে সমস্ত বিধায়ক ও দলীয় কর্মীরা সারা বছর সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাঁদের অভাব-অভিযোগ শোনেন। তবে সাংসদকে ডাকলে উনি কোথাওই যান না, এই অভিযোগ ঠিক নয়। সব থেকে বড় কথা, উনি এক জন সৎ মানুষ।’’