(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (ডান দিকে)। — ফাইল চিত্র।
তমলুকের বিজেপি প্রার্থী তথা প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করল নির্বাচন কমিশন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে প্রকাশ্য সমাবেশে কুকথা বলার অভিযোগে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছিল তৃণমূল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই পদক্ষেপ করল কমিশন। মঙ্গলবার বিকেল ৫টা থেকে ২৪ ঘণ্টার জন্য অভিজিতের প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ অভিজিৎ নিজে ওই সময় প্রচার করতে পারবেন না। ভবিষ্যতে জনসভায় এ ধরনের মন্তব্য করা থেকে তাঁকে বিরত থাকতেও সতর্ক করেছে কমিশন। এই নিয়ে বিজেপিকে কটাক্ষ করেছেন তমলুকের তৃণমূল প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছেন, ‘‘বিজেপিতে সকলেই শুভেন্দু অধিকারী। মুখ খুললেই নর্দমা।’’ বিজেপির দাবি, তৃণমূল অভিজিতের বক্তব্যকে ভুল ভাবে উপস্থাপিত করেছে। তাঁর মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষ কোনও মহিলাকে আক্রমণ করতে পারেন না।
প্রকাশ্য সভায় মমতাকে কুকথা বলার জন্য অভিজিৎকে গত ১৭ মে নোটিস পাঠিয়েছিল কমিশন। জানিয়েছিল, বিজেপি প্রার্থী জবাব না দিলে একতরফা পদক্ষেপ করা হবে। ২০ মে, সোমবার কমিশনকে জবাব দিয়েছিলেন অভিজিৎ। সেই জবাব খতিয়ে দেখেছে কমিশন। সূত্রের খবর, জবাব পড়ার পরেও তাদের মনে হয়েছে, ‘কুরুচিকর ভাবে ব্যক্তি আক্রমণ’ করেছেন অভিজিৎ। আর তা করে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন তিনি। পাশাপাশি কমিশন জানিয়েছে, ভারতীয় সমাজে এবং সংবিধানে মহিলাদের বিশেষ স্থান রয়েছে। তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হয়। সে কারণে, এক জন মহিলার সম্মানরক্ষার জন্য সব সময় সচেষ্ট রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। দেশের নির্বাচনে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিরও চেষ্টা করছে কমিশন। নির্বাচনের সময় যাতে কোনও মহিলা অপমানিত না হন, সে দিকেও নজর রয়েছে তাদের। আর এই আবহেই তাদের মনে হয়েছে, অভিজিৎ যে মন্তব্য করেছেন, তা ‘ভারতে এক জন মহিলার মর্যাদার ক্ষয়সাধন’ করছে। বিজেপি প্রার্থীর মন্তব্যকে ‘নিন্দনীয়’ বলেও জানিয়েছে কমিশন।
অভিজিৎ কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি। তাঁর মতো এক জন ব্যক্তি কী ভাবে এই ধরনের মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে কমিশন। জানিয়েছে, এই ঘটনা অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক। পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের সম্মান করাই সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিকেও ধাক্কা দিয়েছে অভিজিতের মন্তব্য। এ সব বিবেচনা করেই অভিজিতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে কমিশন।
কমিশনের নির্দেশ। — নিজস্ব চিত্র
কমিশনের পদক্ষেপের পরেই সরব তৃণমূল। তমলুকে অভিজিতের বিপক্ষে প্রার্থী দেবাংশু। তিনি সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘‘এক জন প্রাক্তন বিচারপতি, যিনি বিজেপির আকালের বাজারে তাদের বাঙালি-ভদ্রলোক মুখ হতে চেয়েছিলেন, তিনি তাঁর জীবনের প্রথম নির্বাচনে কুকথার জন্য শাস্তি পেলেন। বিজেপির কপালটাই পোড়া!’’ বিজেপির যদিও দাবি, কাউকে অসম্মান করার জন্য এ কথা বলেননি অভিজিৎ। রাজ্যসভার সাংসদ তথা বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘যদি কমিশনের মনে হয়, অভিজিতের মন্তব্যে কারও সম্মান, আবেগে আঘাত লেগেছে, তা হলে কমিশন তাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৃণমূল অভিজিতের বক্তব্যকে ভুল ভাবে উপস্থাপিত করেছে। অভিজিতের মতো এক জন উচ্চশিক্ষিত রুচিশীল মানুষ, যার দীর্ঘ পরিচ্ছন্ন ইতিহাস আছে, তিনি কোনও মহিলাকে আক্রমণ করবেন, বিষয়টি এ রকম নয়।’’ এর পর কমিশনকে কটাক্ষ করেছেন শমীক। তিনি বলেন, ‘‘কমিশনকে বলব চোখ কান খোলা রাখুক। যে ভাবে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করা হল, যে ভাবে দাঙ্গার প্ররোচনা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী, ভারত সেবাশ্রমকে কালিমালিপ্ত করলেন, সন্ন্যাসীকে অপমান করলেন, এই বিষয়গুলি তাদেরও দেখা উচিত।’’
মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে নিয়ে ‘অশালীন’ মন্তব্য করার অভিযোগ এনে তমলুকের বিজেপি প্রার্থী অভিজিতের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছিল তৃণমূল। তৃণমূলের দাবি ছিল, মুখ্যমন্ত্রীকে ‘অশালীন’ ভাষায় আক্রমণ করে ‘নিম্নরুচি’র পরিচয় দিয়েছেন প্রাক্তন বিচারপতি। নির্বাচনী আচরণবিধি ভেঙেছেন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে অবিলম্বে ফৌজদারি মামলা শুরু করতে হবে কমিশনকে। বিজেপি প্রার্থীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোনও জনসভা, রোড-শোতে বা একান্ত সাক্ষাৎকারে যোগদানে তাঁকে বিরত রাখতে হবে। অভিজিৎ বা অন্য কোনও বিজেপি নেতা যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের ব্যক্তিগত এবং অসম্মানজনক মন্তব্য না করেন তা-ও নিশ্চিত করার কমিশনে আবেদন জানিয়েছিল তৃণমূল। রাজ্যের শাসকদলের তরফে কমিশনের কাছে অভিজিতের নামে অভিযোগ জানিয়ে চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন।
উল্লেখ্য, কলকাতা হাই কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতিকে নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয় গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। বৃহস্পতিবার ‘এক্স (সাবেক টুইটার)’ হ্যান্ডেলে পোস্ট করে তৃণমূল। তাতে বলা হয়, মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে ‘কুৎসিত এবং অশালীন’ ভাষায় আক্রমণ করেছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ। গত বুধবার হলদিয়ার চৈতন্যপুরে একটি সভা ছিল তমলুকের বিজেপি প্রার্থীর। সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর নাম করে তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তুমি কত টাকায় বিক্রি হও?’’ সে কথা উল্লেখ করেই অভিজিতের কড়া নিন্দা করে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল। হলদিয়ার ওই সভার একটি ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে। যদিও আনন্দবাজার অনলাইন সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি। সেই ভিডিয়োতে অভিজিৎকে বলতে শোনা যায়, ‘‘তৃণমূল বলছে, রেখা পাত্রকে কেনা হয়েছিল ২০০০ টাকায়! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তুমি কত টাকায় বিক্রি হও? তোমার হাতে কেউ ৮ লক্ষ টাকা গুঁজে দিলে চাকরি হয়, কেউ ১০ লক্ষ টাকা দিলে রেশন হাওয়া হয়ে যায়! কেন তোমার দাম ১০ লক্ষ টাকা? তুমি কেয়া শেঠকে দিয়ে মুখে মেকআপ করাও বলে? আর রেখা পাত্র গরিব মানুষ, লোকের বাড়িতে কাজ করে, আমাদের প্রার্থী। সে জন্য তাঁকে ২০০০ টাকায় কেনা যায়?’’ সেই মন্তব্য নিয়েই এ বার পদক্ষেপ করল কমিশন। মঙ্গলবার বিকেল ৫টা থেকে ২৪ ঘণ্টা প্রচার করতে পারবেন না অভিজিৎ নিজে।