সাফল্য: নেতাজি ইনডোরের বাইরে তৃণমূলের সমর্থকদের উল্লাস। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকার অঙ্ক বাজারমূল্যের তুলনায় হয়তো বেশি কিছু নয়। কিন্তু গ্রামের অর্থনীতির নিরিখে লক্ষ্মীর ভান্ডারের এক হাজার টাকা গ্রামের একটি মেয়ের কাছে অনেকটাই। নিজের রোজগারে স্বাধীন ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন গ্রামবাংলার মেয়েরা। সেই স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করছে লক্ষ্মীর ভান্ডার। সেই টাকায় তিনি যেমন নিজের শখ পূরণ করতে পারেন, তেমনই তাঁর সাধ্য মতো স্বামী কিংবা সন্তানের পাশেও দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন।
সর্বোপরি যেটা মনে হয়, লক্ষ্মীর ভান্ডার মেয়েদের সংসারে অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে। গ্রামের মেয়েরা সংসারে বহু ধরনের কাজ করেন, কোনওটি অর্থকরী, কোনওটি সাশ্রয়ী— সে সব কাজের স্বীকৃতি তাঁরা পান না। এই প্রকল্প সেই স্বীকৃতি দিচ্ছে বলেই হয়তো মেয়েরা মনে করছেন। তা না হলে এই প্রকল্প এত জনপ্রিয় কেন?
টেলিভিশনে দেখলাম, লোকসভা ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরে মহিলারা লক্ষ্মীর ভান্ডার মাথায় তুলে উল্লাস প্রকাশ করছেন। রাজ্য সরকার তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওই প্রকল্প নিয়ে নানা ধরনের মতামত কিংবা নাক কুঁচকানো রয়েছে। এমনকি, বিজেপি তাঁকে অনুকরণ করে টাকার পরিমাণ বাড়াবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এটা মানতেই হবে, এই লোকসভা ভোটে রাজ্যের শাসকদলের প্রতি এই বিপুল সমর্থনের পিছনে মহিলাদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। যার নেপথ্যে রয়েছে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প।
এক সময়ে অরবিন্দ কেজরীওয়াল দিল্লিতে মহিলাদের জন্য অনুরূপ প্রকল্প এবং কর্নাটকের কংগ্রেস ‘মহালক্ষ্মী’ প্রকল্প চালু করেছিলেন। যেখানে মেয়েদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা পৌঁছে যেত। লক্ষ্মীর ভান্ডারেও সে ভাবে মহিলাদের অ্যাকাউন্টে টাকা পৌঁছে যায়। সেই টাকা তাঁরা তাঁদের ইচ্ছে মতো কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে খরচ করতে পারেন। এটা তো এক ধরনের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বটেই। এই প্রকল্প থেকে উপকৃত মহিলারা নিজের রোজগারের ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন। তবে আবার সংবাদমাধ্যমেই দেখেছি, সন্দেশখালির প্রতিবাদী মহিলারা জানিয়েছেন, প্রতিবাদ শুরু হওয়ার পরে তাঁরা আর লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পান না। অর্থাৎ, এটা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করারও একটা পথ, যেটা শাসক চাইলে প্রতিবাদী বা বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। অবশ্য এ কথা আমি সংবাদমাধ্যম দেখে বলছি। সরাসরি এই প্রকল্প নিয়ে আমার কাজের অভিজ্ঞতা নেই। এটা যদি হয়ে থাকে, তবে তা দুর্ভাগ্যের।
হয়তো মেয়েরা ভাবছেন, দিদি না থাকলে এই আর্থিক স্বাধীনতার দিকটি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। যে কারণে মেয়েরা তাঁর দলকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক, এই না চেয়ে এবং বিনা পরিশ্রমে কিছু পাওয়া, সেটা অন্য দিকে একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। তা হল, কর্মবিমুখ মানসিকতা তৈরি হওয়া। এমনিতেই যেখানে আমাদের রাজ্যে মেয়েদের বাইরে অর্থকরী কাজে যোগ দেওয়ার হার অন্য রাজ্যের তুলনায় কম, সেখানে এই প্রবণতা
ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। তবে খয়রাতি তো শুধু মেয়েদের নয়, পুরুষদেরও কর্মবিমুখ করে। কোভিডের সময়ে আমরা দেখেছি, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বইয়ের গাড়ি নিয়ে যাওয়ার লোক পাওয়া যেত না। লোকজন কাজ করতে চাইতেন না। এখনও কাজ না করে খয়রাতির অপেক্ষায় আছেন, এমন মানুষও কম নয়।
কিন্তু আজ, এই ধরনের নেতিবাচক কথা বলতে চাই না। সব ধরনের বুথ-ফেরত সমীক্ষা ভুল প্রমাণ করে বিপুল জনসমর্থন পেয়েছে শাসকদল। সেখানে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প এবং সে জন্য মেয়েদের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। তাই এই মুহূর্তে এই প্রকল্প নিয়ে খুব জটিল করে কিছু ভাবতে চাইছি না, আগামী দিনে নিশ্চয়ই বিশদে ভাবা যাবে।