অযোধ্যার রামমন্দির। — ফাইল চিত্র।
গলির মুখেই হলদে রঙের লোহার পুলিশি ব্যারিকেড। উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী চেয়ার পেতে দিনরাত পাহারায়। গলিতে ঢুকতে গেলেই হাজারো প্রশ্ন, কোথায় যাচ্ছেন? কেন যাচ্ছেন?
গলির শেষে দেখা যায় শাহি ইদগার তিনটি গম্বুজ। পিছনে সিলুয়েটে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি মন্দিরের চূড়া। দুইয়ের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের চৌকি থেকে দিনভর নজরদারি।
শাহি ইদগার গলিতে মুসলিম ঘোসী সম্প্রদায়ের বাস। সাতসকালে গরু-মহিষের দুধ দোয়ান আফজল মিয়াঁ। তাঁর রোজকার খদ্দের ‘কমলা বহেনজি’ সকালে এসে টাটকা দুধ কিনে নিয়ে যান। কমলা জানেন, তাঁর আফজল ভাই দুধে জল মিশিয়ে ঠকাবেন না। ইদগার উল্টো দিকের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলে মথুরার জামা মসজিদ। সৈয়দ আফতাব আলির জামাকাপড় সেলাইয়ের দোকান মসজিদের সিঁড়ির পাশেই। সেলাই মেশিনে ব্যস্ত লক্ষ্মণ পাল সিংহ। কাজ শেষ হলে আফতাব ও লক্ষ্মণ একসঙ্গে বিড়ি ধরিয়ে গল্পে মজেন।
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার পরেই বিজেপি-আরএসএস স্লোগান তুলেছিল, ‘অযোধ্যা তো স্রিফ ঝাঁকি হ্যায়, কাশী-মথুরা অভি বাকি হ্যায়।’ অযোধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রামমন্দির তৈরির পরে মথুরায় শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি-শাহি ইদগা বিবাদ ফের আদালতে পৌঁছেছে। এক দিকে শ্রীকৃষ্ণ বিরাজমানের জন্মভূমিতে মন্দির চেয়ে ন’টি মামলা হয়েছে। উল্টো দিকে মামলা লড়ছে শাহি ইদগা মসজিদ কমিটি। শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমিতে মন্দির ভেঙে ঔরঙ্গজেব ইদগা তৈরি করিয়েছিলেন, এই অভিযোগ তুলে দাবি উঠেছে, ইদগার জমিও শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি ট্রাস্টের হাতে তুলে দেওয়া হোক। মথুরার জেলা আদালত থেকে ইলাহাবাদ হাই কোর্ট হয়ে সেই মামলা সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে।
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ ভোটের প্রচারে মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি ও শাহি ইদগা বিবাদ প্রসঙ্গ না তুললেও অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেছেন, মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমিতেও অযোধ্যার মতো মন্দির হবে। বিজেপি নির্বাচনের বিজ্ঞাপনে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কাশী বিশ্বনাথ করিডরের মতো অন্যান্য ধর্মীয় স্থানও সাজিয়ে তোলা হবে। মথুরায় হিন্দু সেনার মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠন দাবি তুলেছে, ইদগা সরাতে হবে।
আফতাব-লক্ষ্মণের বন্ধুত্বে তাতে চিড় ধরেনি। লক্ষ্মণ পাল উদাসীন মুখে বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, ‘‘ও সব রাজনীতির খেলা। অযোধ্যা-কাশী-মথুরা নিয়ে আমাদের মতো গরিব মানুষের লেনাদেনা নেই।’’ আফতাব আলি সায় দিয়ে বলেন, ‘‘এখন অনেক বছর এ সব নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা চলবে। ও নিয়ে মাথা ঘামানো মানে সময় নষ্ট, অকারণ টেনশন।’’
মথুরা লোকসভা কেন্দ্রে ভোট ছিল ২৬ এপ্রিল। ভোটের আগে হেমামালিনীর লোকসভা কেন্দ্র মথুরার মানুষ নিশ্চিত ছিলেন, এ বারের ভোটে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমির বিবাদ উঠে আসবে। মথুরার ভোটগ্রহণ মিটে গেলেও সেই আশঙ্কা কাটেনি। বরং নরেন্দ্র মোদী দ্বিতীয় দফার ভোটের পর থেকেই মুসলিম-মঙ্গলসূত্র নিয়ে সরব হওয়ায় মথুরার আশঙ্কা বেড়েছিল। এই বুঝি শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমির বিবাদ উঠে এল! এখনও ওঠেনি। তাই ও নিয়ে আর মাথাও ঘামাচ্ছে না মথুরা।
‘‘ব্রজভূমি হল কৃষ্ণ-রাধিকার লীলাখেলার ক্ষেত্র। এখানে মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে থাকতে চান। সবাই জানেন, বাইরে থেকে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি-শাহি ইদগা নিয়ে নতুন করে বিবাদ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। রাজনীতির স্বার্থে।’’ বলছিলেন শাহি ইদগা মসজিদ কমিটির প্রেসিডেন্ট জাহির হাসান। তাঁর বাড়ির লাইব্রেরিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশেই মির্জা গালিবের ছবি। কালিদাসের পাশেই শেক্সপিয়র। ৮৬ বছরের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জাহির মাঝে মাঝেই নজরুল ইসলামের কবিতার বই খুলে বসেন। মুচকি হেসে বলেন, রাজনীতিকদের মুখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মির্জা গালিব, কালিদাসের কথা শোনা যায় না কেন বলুন তো! তাঁর একটাই যুক্তি, ‘‘১৯৬৮ সালেই শাহি ইদগা মসজিদ কমিটির সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি সেবাসঙ্ঘের মধ্যে সমঝোতায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল, মন্দিরের ১৩.৭৭ একর জমির একটা অংশ ইদগার জন্য থাকবে।’’
ইদগা সরিয়ে মন্দিরের পক্ষে অন্যতম মামলাকারী, মথুরার আইনজীবী মহেন্দ্র প্রতাপের অবশ্য দাবি, ওই ইদগার নিচেই আসল মন্দিরের গর্ভগৃহ হয়েছে। হাই কোর্ট ইদগার সমীক্ষায় কমিশন তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট অগস্ট মাস পর্যন্ত তাতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা অবশ্য বলেছেন, মথুরা-কাশীতে মসজিদ ভেঙে মন্দির তৈরির কোনও পরিকল্পনা নেই। মথুরার বিজেপি দফতরে ঘুরলে কিন্তু অন্য কথা শোনা যায়। এখন তো কেন্দ্রে, উত্তরপ্রদেশে বিজেপিই ক্ষমতায়। বিজেপি যখন ক্ষমতায় থাকবে না, তখন না কি ফের মথুরা-কাশীর আন্দোলন শুরু হবে! ঠিক যে ভাবে রামজন্মভূমি আন্দোলনের হাত ধরে বিজেপির উত্থান হয়েছিল।
এ সব শুনেও মন্তব্য করতে চান না জাহির হাসান। হেসে গালিবের শায়েরি শোনান—‘না শুনো অগর বুড়া কহে কোই, না কহো অগর বুড়া করে কোই, রোক লো অগর গলত চলে কোই, বক্শ দো অগর খতা করে কোই (কেউ খারাপ বললে শুনো না, কিছু বোলো না, কেউ ভুল পথে চললে আটকাও, কেউ তোমার ক্ষতি করলে ক্ষমা করে দাও)!’ (চলবে)