অখিলেশ যাদব। ছবি: পিটিআই।
ভারতীয় রাজনীতির প্রাচীন প্রবাদ, দিল্লির সিংহাসনের রাস্তা উত্তরপ্রদেশের মধ্য দিয়েই যায়। অর্থাৎ, দিল্লিতে ক্ষমতায় আসতে হলে উত্তরপ্রদেশে ভাল ফল করতে হয়। নরেন্দ্র মোদী-যোগী আদিত্যনাথের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সত্ত্বেও সেই উত্তরপ্রদেশেই বিজেপির রেলগাড়ি হোঁচট খেল।
লোকসভা ভোটের ফলে এনডিএ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল ঠিকই। কিন্তু বিজেপি যে একার জোরে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২টি আসন জিততে পারল না, তার জন্য উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসন কমে যাওয়া প্রধান কারণ হয়ে উঠল। যে উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরে বিজেপি রামমন্দিরের আবেগেই লোকসভা নির্বাচন জিতে যাওয়ার আশা করছিল, যে উত্তরপ্রদেশের বারাণসী-মথুরায় অযোধ্যার মতোই মসজিদের বদলে মন্দিরের দাবি উঠেছে, সর্বোপরি যে উত্তরপ্রদেশ থেকে খোদ মোদী লোকসভার সাংসদ, সেই উত্তরপ্রদেশেই বিজেপির ভোট কমল। বিজেপির উত্তরপ্রদেশে ‘অপ্রত্যাশিত’ খারাপ ফল মুখ্যমন্ত্রী যোগীর ‘ভূমিকা’ ও তাঁর ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়েও জল্পনা তৈরি করে দিল। ২০০৪ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকারের বিদায়ের সময়েও লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে বড় ধাক্কা খেয়েছিল বিজেপি। সে বার এই রাজ্যে মাত্র দশটি আসন পেয়েছিল তারা।
মোদী লোকসভা ভোটের প্রচারে যাঁদের ‘শাহজাদা’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন, সেই দুই শাহজাদা— অখিলেশ যাদব ও রাহুল গান্ধীই বিজেপির ভোটে ধস নামিয়ে শেষ হাসি হাসলেন। বিশেষত সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ তাঁর নিজের যাদব সম্প্রদায় বাদে অন্যান্য ওবিসি এবং দলিতদের প্রার্থী করার যে রণকৌশল নিয়েছিলেন— তাতে রামমন্দিরকে ঘিরে হিন্দুত্বের আবেগ নয়, অখিলেশের ‘পিডিএ’ বা ‘পিছড়ে (অনগ্রসর), দলিত, অল্পসংখ্যক (সংখ্যালঘু)’ ভোটব্যাঙ্ককে লক্ষ্য করে জাতপাতের সমীকরণই বাজিমাত করল। রুটি-রুজি, বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, অগ্নিবীর প্রকল্প নিয়ে ক্ষোভ এবং বিজেপি চারশোর বেশি আসনে জিতে এলে সংবিধান বদলে দেওয়ার আতঙ্ক পদ্মফুলে কাঁটা হয়ে উঠল। অখিলেশের ভোটব্যাঙ্কে ভর করে কংগ্রেসও উত্তরপ্রদেশে অমেঠী-রায়বরেলীর পাশাপাশি আরও চারটি আসন জিতে নিল।
২০১৪-য় মোদীর ক্ষমতায় আসার পিছনে বিজেপির উত্তরপ্রদেশে ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসনে জয় বড় ভূমিকা নিয়েছিল। ২০১৯-এ আসন কমলেও বিজেপি ৬২টি আসন পেয়েছিল। সেই তুলনায় বিজেপি এ বার উত্তরপ্রদেশে ২৯টির মতো আসন হারাতে চলেছে। আর অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি ৩৭টি আসনে জিতে বিজেপি, কংগ্রেসের পরে লোকসভায় তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এসেছে। অন্য দিকে মায়াবতী না বিজেপির দিকে, না বিরোধীদের দিকে গিয়ে বিভিন্ন আসনে বিরোধীদের ভোট কাটার প্রার্থী দিয়েছিলেন। মায়াবতী শুধু যে শূন্য হাতে ফিরছেন তা নয়, তাঁর দলিত ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরায় বহুজন সমাজ পার্টির ভোটের হার তলানিতে।
রাহুল বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশের মানুষ কামাল করে দিয়েছেন। অনেক রাজ্যের মানুষই কামাল করেছেন। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের মানুষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। সংবিধানের বিপদ বুঝে উত্তরপ্রদেশ সংবিধান রক্ষা করেছে। সব রাজ্যকেই ধন্যবাদ। বিশেষ করে ইন্ডিয়া জোটকে সমর্থনের জন্য উত্তরপ্রদেশের মানুষকে।”
লোকসভা ভোটের মরসুমে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়াল দাবি করেছিলেন, মোদী সরকার ফের ক্ষমতায় ফিরলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে যোগী আদিত্যনাথকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেই আশঙ্কা যোগীর ঘনিষ্ঠ শিবিরেও ছিল। বিজেপির একাংশ মনে করছিলেন, যোগী ভবিষ্যতে যাতে অমিত শাহের বদলে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার না হয়ে ওঠেন, তার জন্য মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানের মতো যোগীকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে। খুব বেশি হলে কেন্দ্রে মন্ত্রী করা হতে পারে।
রামমন্দিরের আবেগ স্তিমিত হয়ে যাওয়ার পরে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির বাজি ছিল, মোদীর বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধাভোগী বা ‘লাভার্থী’রা এবং যোগী সরকারের ‘আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা’-র সাফল্য। কিন্তু বিজেপি নেতারা মনে করছেন, যোগী প্রচারে থাকলেও উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে সে ভাবে গা লাগাননি। রামমন্দিরের নেপথ্যে যোগীর ভূমিকাকে খাটো করে মোদী সব কৃতিত্ব নিয়ে যাচ্ছেন বলে অখিলেশরাও নিয়মিত প্রচার করে গিয়েছেন। সে সবের খেসারত দিতে হয়েছে বিজেপিকে।
যোগীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা উত্তরপ্রদেশে ইন্ডিয়া মঞ্চের সাফল্যের পিছনে অখিলেশকে পুরো কৃতিত্ব দিচ্ছেন। চৌধরি চরণ সিংহকে মোদী সরকার মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়ার পরে তাঁর নাতি জয়ন্ত সিংহের রাষ্ট্রীয় লোক দল ‘ইন্ডিয়া’ ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। তার পরেও অখিলেশ দমে না গিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে মাঠে নেমেছিলেন। গত লোকসভা ভোটে মায়াবতীর সঙ্গে জোট বেঁধে লড়ে আসা অখিলেশ এ বার মায়াবতীরই দলিত ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসাতে ১৫ জন দলিতকে প্রার্থী করেন। যাদব-মুসলমিদের দল বলে পরিচিত সমাজবাদী পার্টি এ বার পাঁচ জন যাদবকে প্রার্থী করেছিল। তাঁরা মুলায়ম-অখিলেশের পরিবারের। মুসলিম প্রার্থী ছিলেন চার জন।
উল্টো দিকে যাদব সম্প্রদায় বাদে অন্য ওবিসিদের মধ্য থেকে অখিলেশ ২৭ জনকে প্রার্থী করেছিলেন। এ ছাড়া ১১ জন উচ্চবর্ণকে— তাঁদের মধ্যে চার জন ব্রাহ্মণ, দু’জন ঠাকুর, দু’জন বৈশ্য, এক জন পঞ্জাবি খত্রীকে প্রার্থী করেন তিনি। বিজেপি যখন মোদী-অমিত শাহকে সামনে রেখে বিরাট বিরাট জনসভা করে প্রচারে নেমেছিল, সেখানে অখিলেশ ছোট ছোট ‘নুক্কড় সভা’ বা পথসভা করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছেছিলেন। ফলে সমাজের সব অংশের ভোট কুড়োতে অখিলেশ সফল হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল, মধ্য ভাগ ও পূর্বাঞ্চলের পাশাপাশি বুন্দেলখণ্ডেও সমাজবাদীর পতাকা উড়েছে।
একই কৌশলে কংগ্রেসের প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরাও অমেঠী-রায়বরেলীতে সারাদিন ছোট ছোট ‘নুক্কড় সভা’ বা পথসভা করে সাফল্য পেয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া-র সাফল্য নিয়ে রাহুল বলেছেন, ‘‘আমার বোন প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরারও এর পিছনে যথেষ্ট পরিশ্রম রয়েছে।’’