মহারাষ্ট্রের মহাযুদ্ধে বাজিমাত কার? — ফাইল চিত্র।
মহারাষ্ট্রে দল ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ভোটের ফলে দেখা গেল, ভোট ভাঙানো গেল না। মহারাষ্ট্রের মহাযুদ্ধে বড় জয় পেল বিরোধীদের জোট ‘ইন্ডিয়া’। অনেকটা পিছিয়ে গেল বিজেপি। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ৪৮ আসনের মহারাষ্ট্রে বিজেপি জিতেছে ৯টি আসনে, একনাথ শিন্ডের শিবসেনা ৭টি আসন এবং এনসিপির অজিত পওয়ার গোষ্ঠী একটি আসনে জয়লাভ করেছে। অন্য দিকে, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস পেয়েছে ১৩টি আসন, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ৯টি, শরদ পওয়ারের এনসিপি ৭টি আসনে জয়লাভ করেছে। নির্দল প্রার্থী জিতেছেন একটি আসনে।
রাজনীতির চিরচেনা প্রবাদ— ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সড়ক উত্তরপ্রদেশ দিয়ে যায়। অর্থাৎ, যে রাজ্যেরই বাসিন্দা আপনি হন, লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশের ৮০ আসনে দুর্দান্ত ফল করাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মূল চাবিকাঠি। কিন্তু ঘটনা হল, পাকা সেই সড়কে পৌঁছতে পেরোতে হয় মহারাষ্ট্র। যে মহারাষ্ট্রে এ বারের লোকসভার লড়াই দুই ‘মহা’র মধ্যে। পওয়ার, উদ্ধবের ‘মহাবিকাশ আঘাডী’ বনাম শিন্ডে-অজিত-বিজেপির ‘মহাদ্যুতি’। মহারাষ্ট্রের ‘মহা-যুদ্ধ’!
মোট ৪৮ আসনের এই রাজ্য লোকসভার আসনসংখ্যার নিরিখে উত্তরপ্রদেশের ঠিক পরেই। ২০১৯ সালে এই রাজ্যে সর্বাধিক আসন জিতেছিল বিজেপি। মোট ২৩ আসনে জিতেছিলেন পদ্মপ্রার্থীরা। দ্বিতীয় স্থানে ছিল অবিভক্ত শিবসেনা। তারা পেয়েছিল ১৮টি আসন। তৃতীয় স্থানে এনসিপি। তারা পেয়েছিল ৪টি আসন। এ ছাড়া কংগ্রেস, এআইএমআইএম এবং নির্দল পেয়েছিল একটি করে আসন। সব মিলিয়ে ৪৮।
অনেকেই মনে করেন, ২০১৯ সালে মোদীর দ্বিতীয় বারের জন্য মসনদে ফেরায় সহায় হয়েছিল চড়া দাগের জাতীয়তাবাদ। বালাকোট, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর তুফানে ভর করে সে বার অবলীলায় বিরোধীদের উড়িয়ে দিতে পেরেছিল এনডিএ। কিন্তু অনেকে এ-ও মনে করেন যে, বার বার এমন হয় না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? বিগত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রের ফলাফলের তুল্যমূল্য বিচার এই ধারণাকে পোক্ত করে না। কারণ, ঝোড়ো বা মৃদুমন্দ— হাওয়ার বেগ যেমনই থাক, মহারাষ্ট্রে বিগত লোকসভার ভোটের ফল অন্য কথা বলে।
যে বার নরেন্দ্র মোদী প্রথম দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন, সেই ২০১৪ সালে মহারাষ্ট্রের লোকসভা ভোটে বিজেপি ২৩, শিবসেনা ১৮, এনসিপি ৪, কংগ্রেস ২ এবং নির্দল ১টি আসন পেয়েছিল। অর্থাৎ, ২০১৯ সালে প্রায় একই ফলের পুনরাবৃত্তি হয়েছিল মহারাষ্ট্রে। শুধু কংগ্রেসের একটি আসন কমেছিল। বাদবাকি যে-কে সেই। অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদের পাখায় চেপে ২০১৯ সালে গোটা দেশে দুর্দান্ত ফল করলেও বিজেপি কিন্তু মহারাষ্ট্রে নিজের ২০১৪ সালের রেকর্ড ভাঙতে পারেনি।
২০১৪ এবং ২০১৯-এর লোকসভায় কেমন ছিল ফল? — গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে যে এনডিএ মহারাষ্ট্রের ৪৮টির মধ্যে ৪১টি আসন পকেটে পুরে উত্তরপ্রদেশের পাকা সড়কে উঠেছিল, এ বার তাতে বদল আসার সম্ভাবনা ছিল ভরপুর। প্রাথমিক ভাবে কিছু কিছু জায়গায় ঠোক্কর খেলেও দুই ‘মহা’ শিবিরেই আসন সমঝোতা দানা বেঁধে গিয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, ৪৮ আসনের মধ্যে উদ্ধবের সেনা (ইউবিটি) লড়াই করবে ২১টি আসনে, জোটসঙ্গী শরদ পওয়ারের নেতৃত্বাধীন এনসিপি (শরদচন্দ্র পওয়ার) লড়বে ১০টি আসনে এবং কংগ্রেস লড়বে ১৭টি আসনে। অন্য দিকে, মহাদ্যুতি শিবিরের বিজেপি লড়বে ২৯টি আসনে, একনাথ শিন্ডের শিবসেনা ১৫টি আসনে এবং অজিত পওয়ারের গোষ্ঠী লড়াই করবে বাকি আসনগুলিতে। তার মধ্যে অবশ্য একটি আসন অজিত ছেড়েছিলেন রাষ্ট্রীয় সমাজ পক্ষ (আরএসপি) প্রতিষ্ঠাতা মহাদেব জানকরকে। সেই ফল বলছে, ৪৮ আসনের মহারাষ্ট্রে বিজেপি জিতেছে ১০টি আসনে, একনাথ শিন্ডের শিবসেনা ৭টি আসনে এবং এনসিপির অজিত পওয়ার গোষ্ঠী একটি আসন জয়লাভ করেছে। অন্য দিকে, মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস পেয়েছে ১৩টি আসন, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা ৯টি, শরদ পওয়ারের ৭টি আসনে জয়লাভ করেছে। নির্দল প্রার্থী জিতেছেন একটি আসনে।
২০১৯ সালে মোদী দ্বিতীয় বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু। দল ভেঙেছে, মহারাষ্ট্রে আমূল বদলে গিয়েছে জোটের কাঠামোও। ২০১৯ সালে যে শিবসেনার হাত ধরে মহারাষ্ট্রে লড়াই করেছিল বিজেপি, এখন তা আড়াআড়ি দু’টুকরো। এক পক্ষ বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র তথা মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের গোষ্ঠী। অপর দিকে, তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিজেপির সমর্থন নিয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসা একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী।
বিধানসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে লড়েছিলেন উদ্ধব। কিন্তু ফল বেরোতেই মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিজেপির মতভেদ চূড়ান্ত আকার নেয়। উদ্ধব এনডিএ ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাত মেলান কংগ্রেস এবং এনসিপির সঙ্গে। তৈরি হয় ‘মহাবিকাশ আঘাডী’। উদ্ধবকে মুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপিকে কোণঠাসা করে দেয় মহারাষ্ট্রের সেই বেনজির জোট। কিন্তু মহা-আকাশে দ্রুত পট পরিবর্তন হয়। আচমকা মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য তথা একদা বালাসাহেবের ‘ডান হাত’ একনাথ শিন্ডে ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান। তার পরেই তাঁকে দেখা যায় গুজরাতের সুরাতের বিমানবন্দরে চার্টার্ড বিমান থেকে নামছেন। কিন্তু গুজরাত কেন? শুরু হয় নতুন জল্পনা। যে জল্পনা ক্রমশ ডালপালা মেলতে থাকে। দেখা যায়, শুধু একনাথই নন, ‘নিখোঁজ’ মন্ত্রিসভার আরও কয়েক জন সদস্যও। জল্পনা আকাশ ছোঁয়, যখন ‘শিন্ডে সেনা’ একই ফ্রেমে ধরা দেন অসমের এক বিলাসবহুল রিসর্টে। সেই সময় থেকে শিন্ডে গোষ্ঠী দাবি করতে থাকে, কংগ্রেস এবং পওয়ারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যে সরকার তৈরি করেছেন উদ্ধব, তাতে তাঁদের মনের সায় নেই! গুজরাত, অসম হয়ে গোয়া ঘুরে যত ক্ষণে শিন্ডে গোষ্ঠীর বিমান মুম্বই বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়েছিল, তত ক্ষণে ‘খেলা’ বদলে গিয়েছে।
‘পরিবর্তিত’ পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেন শিন্ডে। তাঁকে সমর্থন দেয় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রীর পদ হারান উদ্ধব। মহাবিকাশ আঘাডী জোট একে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে চিহ্নিত করে। তবে এখানেই সেই পালা শেষ হয়নি। মরাঠা রাজনীতির ‘ভীষ্ম পিতামহ’ শরদ পওয়ারের এনসিপিও অক্ষত নেই। সেই দলেও কাকা-ভাইপো দ্বন্দ্বের ফলস্বরূপ ভাঙন হয়েছে। সেখানে কাকা শরদ উদ্ধব এবং কংগ্রেসের সঙ্গে থাকলেও ভাইপো অজিত হাত মিলিয়েছেন বিজেপি এবং শিন্ডে গোষ্ঠীর সঙ্গে। জনশ্রুতি, দুর্নীতির শাস্তি থেকে বাঁচতেই দলবদল একনাথ শিন্ডে, অজিত পওয়ারদের। এ বারের লোকসভার মহাযুদ্ধে সেই বিশ্বাসঘাতকতার জবাব ‘মরাঠি মনহুস’ বিলক্ষণ দেবেন, এমনটাই আশা ছিল আঘাডীর।
অন্য দিকে, মোদীর ৪০০ আসন পাওয়ার দাবির অঙ্কেও মহারাষ্ট্র ছিল বিরাট জায়গা জুড়ে। বিশাল রাজ্যে বিগত দিনে যে রাজনৈতিক জোট দেখতে মানুষ অভ্যস্ত ছিলেন, তা এখন অতীত। নবীন জোটের নানাবিধ নতুন সমীকরণ মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত মহাদ্যুতি বাজিমাত করতে পারবে কি না, তার জন্যই অপেক্ষা ছিল সারা দেশের। দেখা গেল, দিনের শেষে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ই বাজিমাত করল মহারাষ্ট্রে।
উদ্ধব এবং শরদের কাছে এই লোকসভার লড়াই ছিল সম্মানরক্ষার ‘মহাযুদ্ধ’। আর শিন্ডে এবং অজিতের কাছে অস্তিত্বরক্ষার ‘মহাসংগ্রাম’। সর্বোপরি, বিজেপির কাছে ‘সর্বশক্তিমান’ হয়ে থাকার চ্যালেঞ্জ। রাজনীতির ময়দানে কেউ কাউকে এক ফোঁটাও জমি ছাড়েনি। লড়াই হয়েছে সেয়ানে সেয়ানে। ভোটের ফলাফলেও তারই প্রতিফলন।