গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এ বারও শূন্যের গেরো কাটল না কংগ্রেসের। উত্তরাখণ্ড আস্থা রাখল সেই মোদী-শাহের নেতৃত্বেই। ‘দস্তুর’ মেনে ফের বিজেপির ঝুলিতে গেল রাজ্যের সব ক’টিই আসন!
জন্মলগ্ন থেকেই কংগ্রেস-বিজেপির দ্বৈরথ দেখে আসছে হরিদ্বার-হৃষীকেশ-মায়াবতীখ্যাত উত্তরাখণ্ড। ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রতি পাঁচ বছরে রাজ্যে ক্ষমতাবদল হয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু ২০২২ সালের বিধানসভা ভোট। দ্বিতীয় বার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে রাজ্যের মসনদ দখল করেছে বিজেপি। রাজ্যের ভোটে মোটামুটি ভারসাম্য থাকলেও দিল্লিবাড়ির লড়াইয়ে বরাবরই বিজেপির প্রতি ‘আনুগত্য’ দেখিয়েছেন ঐতিহ্যঋদ্ধ দেবভূমির মানুষ। একমাত্র ২০০৯ সালের নির্বাচন ছাড়া প্রতিটি লোকসভা ভোটেই পদ্মশিবিরের একাধিপত্য থেকেছে। ২০১৪ এবং ২০১৯— গত দুই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর ঝড়ে উত্তরাখণ্ডে দাঁত ফোটাতে পারেননি রাহুল গান্ধীরা। দু’বারই রাজ্যের পাঁচটি আসনের মধ্যে পাঁচটিই দখল করেছিল বিজেপি। ২০১৪ সালে তাদের ঝুলিতে গিয়েছিল ৫৫ শতাংশেরও বেশি ভোট। পুলওয়ামাকাণ্ড ও ভারতীয় সেনার বালাকোট অভিযানের পর দেশ জুড়ে ‘জাতীয়তাবাদী হাওয়া’য় ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার বেড়ে ৬১ শতাংশেরও বেশি হয়। এ বারও পাঁচটি আসন দখল বিজেপির। তবে তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার কমেছে। কমে হয়েছে ৫৭ শতাংশ।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৯ সালের ভোটে দেশে বিজেপি একাই ৩০৩ আসন পেয়েছিল। এ বার তাদের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নিজেদের ঝুলিতে ৩৭০ আসন এনে এনডিএ-কে ৪০০ পার করানো। বিজেপির ‘প্রাণভোমরা’ লুকিয়ে হিন্দিবলয়ে। আরও স্পষ্ট করে বললে হিন্দিবলয়ের দশটি রাজ্যে— বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড। এই বলয়ে রয়েছে লোকসভার ২২৫ আসন। দেশে সব মিলিয়ে ৫৪৩ আসনের মধ্যে সরকার গড়তে যেখানে ২৭২টি আসন লাগে, সেখানে শুধু হিন্দিবলয় থেকেই গত ভোটে এনডিএ জিতেছিল ২০৩ আসনে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, গোটা দেশের বিচারে উত্তরাখণ্ডের মতো মাত্র পাঁচটি আসনের ছোট রাজ্যের আর কতই বা গুরুত্ব? কিন্তু লক্ষ্য যেখানে ৪০০ টপকানো, সেখানে নিজেদের ‘শক্ত ঘাঁটি’তে একটি আসনেও হারা মানে বিরোধীদের ‘নৈতিক জয়’। তা ছাড়া, মোদীর সাধের চারধাম প্রকল্পের জন্যেও উত্তরাখণ্ড দখলে রাখা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে বিজেপি।
বিজেপির অন্দরে একটি কথা চালু রয়েছে। তা হল, দিল্লি দখল হবে উত্তরপ্রদেশের রাস্তা ধরে। আর ‘হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা’ বাস্তবায়িত করার পথ দেখাবে উত্তরাখণ্ড! সঙ্ঘ-ঘেঁষা পদ্মনেতারা তেমনই মনে করেন। বিরোধীদেরও দাবি, ২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ওই প্রকল্পের ‘আস্ত গবেষণাগার’ হয়ে উঠেছে কেদার-বদ্রীর মাটি। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ সে দাবি নস্যাৎ করে বলেছেন, ‘‘ভারতকে আমরা হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে দেখি না। আমরা সংবিধান মেনে চলি।’’
সংরক্ষণ-বিরোধী আন্দোলন এবং উন্নয়নের দাবিদাওয়া সামনে রেখে ২০০০ সালে উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড রাজ্য তৈরি হয়েছিল। গাড়োয়াল-কুমায়ুন নির্বিশেষে ব্রাহ্মণ ও ঠাকুরেরাই উত্তরাখণ্ডের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী সেখানে ৮০ শতাংশেরও বেশি নাগরিক হিন্দু। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ ঠাকুর আর প্রায় ২৫ শতাংশ ব্রাহ্মণ। এই দুই গোষ্ঠী থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বাছা হয়ে থাকে। কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয় পক্ষই তা করে এসেছে। ঠাকুর-ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য থাকলেও উত্তরাখণ্ডের অন্তত দু’টি আসনে ফলাফল বদলে দেওয়ার মতো দলিত ও সংখ্যালঘু ভোটও রয়েছে। মূলত হরিদ্বার, দেহরাদূন, নৈনিতাল ও উধমসিংহ নগরের কিছু এলাকায়। এককালে দলিতেরা (মূলত যাটব ভোট) মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি)-র দিকে ঝুঁকেছিল। ধীরে ধীরে সেই ভোটব্যাঙ্কের একাংশে ভাগ বসিয়েছে বিজেপি। সংখ্যালঘু ভোট অবশ্য বরাবর কংগ্রেসেরই ছিল প্রথাগত ভাবে।
তবে মোটের উপর হিসাব বলে, গাড়োয়াল, অর্থাৎ সমতলের ঠাকুর আর পাহাড়ি কুমায়ুনের ব্রাহ্মণ ভোট পকেটে পুরতে পারলেই উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতাদখল সম্ভব। সেই লক্ষ্যে এ বারের লোকসভা ভোটে বিজেপি বিধানসভায় ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’র বিল পাশ, পড়শি রাজ্য উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধন ও সর্বোপরি মোদীর ভাবমূর্তিকে সামনে রেখেই প্রচার চালিয়েছিল। অন্য দিকে, কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় বিষয়ে জোর দিয়ে ভোট-বৈতরণী পার করা। সেনাবাহিনীতে চার বছরের অস্থায়ী কাজের জন্য মোদী সরকারের ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ হয়েছিল উত্তরাখণ্ডে। কুমায়ুন থেকে গাড়োয়াল সর্বত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পথে নেমেছিলেন তরুণেরা। ‘ওয়ান র্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন’ (ওরোপ)-এর দাবিতে গত ফেব্রুয়ারি মাসেও উত্তরাখণ্ডে অনশনরত এক অবসরপ্রাপ্ত সেনার মৃত্যু ঘটেছে। তরুণদের সেই ক্ষোভকে ভোটের প্রচারে লাগাতার কাজে লাগানোর চেষ্টা করে গিয়েছিল কংগ্রেস।
রাজ্যের পাঁচ আসনের মধ্যে এ বার কাঁটায় কাঁটায় টক্কর ছিল হরিদ্বার ও পওড়ি গাড়োয়াল আসনে। গত বার হরিদ্বার আসনে জিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন রমেশ পোখরিয়াল নিশঙ্ক। এ বার বিজেপি টিকিট দিয়েছিল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ত্রিবেন্দ্র সিংহ রাওয়াতকে। হরিদ্বারে কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হরিশ রাওয়াতের পুত্র বীরেন্দ্র রাওয়াতকে। বীরেন্দ্র প্রার্থী হলেও মেঘনাদের মতো মেঘের আড়াল থেকে তাঁর হয়ে লড়ে গিয়েছিলেন হরিশ। গত বিধানসভা ভোটে পরাজয়ের পর এই নির্বাচন তাঁর কাছে ঘরে-বাইরে অস্তিত্বরক্ষার ছিল। কিন্তু শেষ হাসি হাসলেন ত্রিবেন্দ্রই। জিতলেন দেড় লক্ষেরও বেশি ভোটে।
গাড়োয়াল আসনে বিজেপি প্রার্থী করেছিল দলের জাতীয় মুখপাত্র অনিল বালুনিকে। উল্টো দিকে, প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি গণেশ গোদিয়ালকে প্রার্থী করেছিল কংগ্রেস। দু’বছর আগে হৃষীকেশে অঙ্কিতা ভান্ডারি হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই গাড়োয়ালে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। এক বিজেপি নেতার পুত্রের বিরুদ্ধে বছর উনিশের তরুণীকে খুনের অভিযোগ উঠেছিল। বেগতিক বুঝে পরে সেই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু ক্ষোভের আঁচ থেকে গিয়েছিল। তা নিয়ে লাগাতার বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী। মোদী সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে জোশীমঠে বিপর্যয় নিয়েও সুর চড়িয়েছিলেন। তাতে পরিস্থিতি এমন হয় যে, জোশীমঠে অনিলের হয়ে প্রচারে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভোট চাইতে দেখা যায় দলের রাজ্য সভাপতিকে। তখন থেকেই গাড়োয়াল আসন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। জল্পনা তৈরি হয় বিজেপির অন্দরেও। গাড়োয়াল আসন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে আরও একটি কারণে। এ বার গাড়োয়ালে বিজেপির প্রচারের ধরন দেখে অনেকেই ১৯৮২ সালের উপনির্বাচনের সঙ্গে মিল পেয়েছিলেন। যে বার হেমবতী নন্দন বহুগুণাকে হারাতে প্রায় গোটা মন্ত্রিসভাকেই গাড়োয়ালে প্রচারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তা সত্ত্বেও ওই ভোটে হেরেছিল কংগ্রেস। এ বার একই ভাবে অনিলের হয়ে প্রচারে শাহ, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে পাঠিয়েছিলেন মোদী। ইন্দিরা পারেননি। মোদী পারলেন। শেষমেশ জিতিয়েই আনলেন বালুনিকে। তিনিও দেড় লক্ষের বেশি ভোটে জিতেছেন।
বাকি তিন আসন— তেহরি গাড়োয়াল, আলমোড়া এবং নৈনিতাল-উধমসিংহ নগরে গত বারের জয়ী প্রার্থীদেরই টিকিট দিয়েছিল বিজেপি। তেহরি গাড়োয়ালে রাজবধূ মালা রাজ্যলক্ষ্মী শাহের বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল জোটসিংহ গানসোলাকে। তিনি হেরেছেন। জিতলেন রাজবধূ। নৈনিতাল-উধমসিংহ নগরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় ভাটের বিরুদ্ধে রাহুল-ঘনিষ্ঠ প্রকাশ জোশীকে টিকিট দিয়েছে তারা। ওই আসনে তিন লাখের বেশি ভোটে জিতেছেন অজয়। আর আলমোড়ায় বিজেপির অজয় টামটার প্রতিপক্ষ ছিলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ টামটা। দু’লক্ষের বেশি ভোটে হেরেছেন তিনি।