গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পুনরাবৃত্তি! কর্নাটকে বিজেপি জিতল ১৭ আসনে। গত বারের তুলনায় অনেকটাই জমি হারাল তারা। গত লোকসভা নির্বাচনে অর্থাৎ, ২০১৯ সালে দক্ষিণের এই রাজ্যে ২৮টির মধ্যে ২৫টিতে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। অন্য দিকে, হারানো জমি ছিনিয়ে নিতে সফল রাজ্যের শাসকদল কংগ্রেস। এ বার ৯টি আসনে জিতেছে তারা। ২০১৪ সালের মতোই। যেখানে গত বার কংগ্রেস জিতেছিল মাত্র একটি আসনে। নিজেদের ‘গড়’ বলে পরিচিত হাসন হারাল জেডিএস। সেখানে ধর্ষণে অভিযুক্ত প্রজ্বল রেভান্না পরাজিত হয়েছেন। তিনটি আসনে লড়ে দু’টি আসনে জিতেছে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার দল জেডিএস। ঠিক যেমন তারা জিতেছিল ২০১৪ সালে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা এবং বালাকোটকাণ্ডের পর অনেকটাই ‘উল্টেপাল্টে’ গিয়েছিল এই পরিসংখ্যান।
কর্নাটকে লোকসভা আসনের সংখ্যা মোট ২৮। তবে শুধু আসনসংখ্যা দিয়ে এই রাজ্যের গুরুত্ব বিচার করা যাবে না। বিজেপি, কংগ্রেস হোক বা জনতা দল সেকুলার (জেডিএস)— তিন দলের কাছেই কর্নাটক ছিল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণে একমাত্র এই রাজ্যেই বিজেপির উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। ১৯৯১ সালে প্রথম বার এই রাজ্যে তিনটি আসন জিতেছিল বিজেপি। সেই শুরু। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ২৮টির মধ্যে ২৫টি লোকসভা আসনে জয়ী হয়েছিল তারা। যদিও তার নেপথ্যে বড় ভূমিকা নিয়েছিল পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলা এবং বালাকোটে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’।
ওই দুই ঘটনাকে ‘হাতিয়ার’ করেই ভোট বৈতরণী পার করেছিল বিজেপি। সারা দেশে একাই পেয়েছিল ৩০৩টি আসন। তখনও কর্নাটক এবং তেলঙ্গানা ছাড়া দক্ষিণের আর কোনও রাজ্যে তেমন ছাপ ফেলতে পারেনি বিজেপি। তেলঙ্গানায় বিজেপি পেয়েছিল চারটি আসন। তাদের ‘দাক্ষিণাত্য বিজয়’-এর স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল। সেই স্বপ্নপূরণের অন্যতম চাবিকাঠি কর্নাটক ধরে রাখাই ছিল বিজেপির চ্যালেঞ্জ। আগের নির্বাচনের মতো সফল না হলেও রাজ্যে তারা ১৭টি আসনে জয়ী। জেডিএসের কাছে এ বারের লোকসভা ভোট ছিল অস্তিত্ব রক্ষার। আর কর্নাটকের কংগ্রেস সরকারের কাছে এ বারের নির্বাচন ছিল মর্যাদা কায়েমের। কংগ্রেস তাতে অনেকটাই সফল। গত বারের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে আসন সংখ্যা, যেমন হয়েছে বাকি দেশে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কর্নাটকের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় মূলত দুই সম্প্রদায়। ভোক্কালিগা এবং লিঙ্গায়েত। রাজ্যের দক্ষিণে ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের বাস। চাষাবাদই তাঁদের জীবিকা। এঁরা মূলত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার দল জেডিএসের ‘ভোটব্যাঙ্ক’। রাজ্যে ৫.৩ কোটি ভোটারের মধ্যে ১২ শতাংশ ভোক্কালিগা। আর লিঙ্গায়েতরা ১৭ শতাংশ। উত্তর কর্নাটক হল লিঙ্গায়েত-অধ্যুষিত। লিঙ্গায়েতরা শৈব। মূলত বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক। অতীতে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক ছিল দলিত, সংখ্যালঘু এবং অনগ্রসর শ্রেণি। গত পাঁচ বছরে সেই ভোটব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধারের কাজে নেমেছিল তারা। কিছুটা সফলও হয়েছিল। যার প্রমাণ মিলেছিল ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। ওই ভোটে জেডিএসের ভোক্কালিগা ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসিয়েছিল কংগ্রেস। ভোটে জিতে উপমুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ডিকে শিবকুমার। যিনি নিজেও ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের। কংগ্রেসের আশা ছিল, লোকসভা ভোটে ভোক্কালিগা ভোট অনেকটাই আসবে তাদের বাক্সে।
আবার এই ভোক্কালিগা ভোটের কারণেই লোকসভা ভোটের আগে জেডিএসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল বিজেপি। জেডিএস জোটে গিয়েছিল নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়েছিল জেডিএস। ২২৪টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৯টি আসনে জিতেছিল তারা। তার পরে ‘অস্তিত্ব সঙ্কট’ শুরু হয় দেবগৌড়ার দলের। বিজেপিও তার সুযোগ নিয়েছিল। রাজ্যে ২৮টির মধ্যে তারা জেডিএসের জন্য বরাদ্দ করেছিল ভোক্কালিগা অধ্যুষিত তিনটি আসন— হাসন, মাণ্ড্য এবং কোলার। এর মধ্যে একমাত্র হাসন লোকসভা আসনটিই ২০১৯ সালে ধরে রাখতে পেরেছিল জেডিএস। হাসন বরাবর ‘দেবগৌড়ার দুর্গ’ বলে পরিচিত। ২০১৯ সালে সেখানে জয়ী হয়েছিলেন তাঁর নাতি প্রজ্বল রেভান্না। তখন যদিও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল জেডিএসের। ২০২৪ সালের ভোটে সেই প্রজ্বলকেই প্রার্থী করেছিল জেডিএস। আস্থা রেখেছিল। কিন্তু হাসনে ভোট মিটতেই সেই প্রজ্বলকে সাসপেন্ড করতে বাধ্য হয়েছে জেডিএস। প্রজ্বল ধরে রাখতে পারেননি গত বারের আসন। হাসনে হেরেছেন তিনি। মাণ্ড্য এবং কোলারে জয় পেয়েছে জেডিএস।
ভোটের আবহে এই প্রজ্বলকে নিয়েই তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ ওঠে। প্রজ্জ্বলের ‘যৌন কুকীর্তি’-র শতাধিক ভিডিয়ো ভরা একটি পেন ড্রাইভ প্রকাশ্যে আসে (আনন্দবাজার অনলাইন সেই ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি)। সেই বিতর্কের মধ্যেই ২৬ এপ্রিল হাসনে ভোট হয়ে যায়। সূত্রের খবর, তার পর দিনই দেশ ছাড়েন প্রজ্বল। তাঁর বিরুদ্ধে ‘ব্লু কর্নার’ নোটিস জারি করে ইন্টারপোল। তার পরে কর্নাটকের বাকি ১৪টি আসনে হয় ভোটগ্রহণ। সবগুলি আসনই ছিল উত্তর কর্নাটকে, যেখানে জেডিএসের প্রভাব তেমন ছিল না। ওই ১৪টি আসনে লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের প্রভাব বেশি। বিতর্ক প্রকাশ্যে আসার পর সতর্ক ভাবেই সেই লিঙ্গায়েত ভোট ধরে রাখতে জোটসঙ্গী জেডিএস প্রার্থী প্রজ্বলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিল বিজেপি। জানিয়ে দিয়েছিল, প্রজ্বলকে তারা সমর্থন করে না। অমিত শাহ বলেছিলেন, মহিলাদের যাঁরা নির্যাতন করেন, তাঁদের পাশে তাঁর দল থাকবে না। তিনি কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া এবং উপমুখ্যমন্ত্রী শিবকুমারের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। কটাক্ষ করে জানিয়েছিলেন, ২৬ এপ্রিল ভোক্কালিগা অধ্যুষিত ১৪টি আসনে ভোটের আগেই কেন প্রজ্বলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি? তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ভোক্কালিগা ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবেই ‘ঢিলেমি’ দেখিয়েছিল কর্নাটকের কংগ্রেস সরকার। কারণ, দক্ষিণ কর্নাটকের ওই ১৪টি আসন ভোক্কালিগা-অধ্যুষিত।
গত বিধানসভা ভোটে জেডিএসের থেকে ভোক্কালিগা ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে ২২৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৩৫টিতে জিতে সরকার গড়েছিল কংগ্রেস। পাশাপাশি দলিত, সংখ্যালঘু, অনগ্রসর শ্রেণির ভোটও এসেছিল কংগ্রেসের ঝুলিতে। ভোক্কালিগা ভোটের একটি অংশ কংগ্রেসের ঝুলিতে এসেছিল ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও। সে বার তারা একটি আসনে জয়ী হয়েছিল। বেঙ্গালুরু রুরাল আসনে জয়ী হয়েছিলেন শিবকুমারের ভাই ডি কে সুরেশ। পুলওয়ামা, বালাকোট কাণ্ডের পর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে ‘মোদীঝড়’-এর সামনে সে বার দাঁড়াতে পারেনি কংগ্রেস। একমাত্র ভোক্কালিগা ভোটের জোরে ওই একটি আসনই বার করে নিয়ে এসেছিলেন সুরেশ। ২০১৪ সালে যখন ‘মোদী হাওয়া’ উঠেছিল দেশে, তখন কর্নাটকে ৯টি আসনে জিতেছিল কংগ্রেস। বিজেপি জিতেছিল ১৭টি আসনে। ২০১৯ সালে আর তা ধরে রাখতে পারেনি কংগ্রেস। নেমে গিয়েছিল একটিতে। জেডিএস ২ থেকে কমে হয়েছিল ১।
গত পাঁচ বছরে কর্নাটকে ভোক্কালিগা, দলিত, সংখ্যালঘু, অনগ্রসর শ্রেণির ভোটব্যাঙ্ক অনেকটাই শক্ত করেছে কংগ্রেস। অতীতে দলিতেরা বিজেপিকে ভোট দিত। কিন্তু গত বছর ক্ষমতায় এসে দলিতদের জন্য নানা প্রকল্প চালু করেছে সিদ্দারামাইয়া সরকার। কংগ্রেসের আশা ছিল, দলিত ভোট পুরোপুরি তাদের দখলেই থাকবে। সঙ্গে সংখ্যালঘু ভোটও। তার জেরেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বার বার সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। ‘লভ জিহাদ’ নিয়ে সরব হয়েছে। গত এপ্রিলে হুবলিতে নেহা হিরেমথ নামে এক তরুণীকে কুপিয়ে খুন করা হয়। খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হন ফৈজ খণ্ডুনায়েক। বিজেপি এর নেপথ্যে ‘লভ জিহাদ’-কেই দায়ী করেছিল। অভিযোগ, সে ভাবেই তারা ভোটের মেরুকরণের চেষ্টা করেছিল। নেহার বাবা কংগ্রেস নেতা। তিনিও ‘লভ জিহাদ’-কেই দায়ী করেছিলেন। যদিও পরে রাজ্যের শীর্ষ নেতৃত্বের চাপে মুখ বন্ধ করেন। গোটা ঘটনায় ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছিল রাজ্য কংগ্রেস। কড়া পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে হিন্দু ভোট ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল সিদ্দারামাইয়া সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণ’-এই খুন। ‘লভ জিহাদ’-এর তত্ত্ব তিনি মানতে চাননি। তবে এই ‘লভ জিহাদ’ কংগ্রেসের ভোটবাক্সে তেমন প্রভাব পড়েনি বলেই মনে করা হচ্ছে।