বিশাখাপত্তনমে রাস্তার উপর এখনও পড়ে আছে গাছ। ছবি: এএফপি।
এ যেন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত নগরী!
তিন দিন ধরে গোটা শহরটা প্রায় অন্ধকারে ডুবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত নেই। রাস্তাঘাটে ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে ভেঙে পড়া গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, কাচের টুকরো, ঘরের উড়ে আসা চাল, মোবাইল টাওয়ার। পানীয় জলের সরবরাহ বন্ধ। দুধ নেই, খাবারও অমিল। মোবাইল হোক বা ল্যান্ডলাইন, কোনও সংস্থার পরিষেবাই কাজ করছে না। ভেঙে পড়েছে কয়েক হাজার মোবাইল টাওয়ার। বিধ্বস্ত বিমানবন্দর। রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত। স্তব্ধ সড়ক পরিবহণ। বন্ধ বেশির ভাগ পেট্রোল পাম্প। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হুদহুদের প্রভাবে বিধ্বস্ত বিশাখাপত্তনমের চেহারা এই মুহূর্তে এমনটাই।
মঙ্গলবার দুপুরে বেসামাল সেই শহরে এসে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান রাজ্যপাল ই এস এল নরসিংহ, মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু, দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নাইডু এবং অশোক গজপতি রাজু। বিশাখাপত্তনম শহর এবং আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখেন তিনি। পরে প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকেও বসেন মোদী।
গত রবিবার অন্ধ্র-ওড়িশার উপকূলবর্তী এলাকায় ঘণ্টায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে আছড়ে পড়ে হুদহুদ। এর জেরে অন্ধ্রপ্রদেশে প্রাণ গিয়েছে ২১ জনের। ওড়িশাতেও এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মারা গিয়েছেন ৩ জন। ইতিমধ্যেই ওই দুই রাজ্যের দুর্গত এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণের কাজ চলছে জোরকদমে। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী সূত্রে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত অন্ধ্রে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। এঁদের বেশির ভাগই গাছ চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন। প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ত্রাণ শিবিরে। প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ দুর্গত মানুষের জন্য খাবার এবং পানীয় জলের প্যাকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে অন্ধ্রের ত্রাণ মন্ত্রক সূত্রে জানানো হয়েছে। ত্রাণ, পুনর্বাসন, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ এবং শৌচালয়—এই পাঁচটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বিশেষ দল গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু।
বিপর্যস্ত বিমানবন্দর।ছবি: পিটিআই।
হুদহুদ আছড়ে পড়ার দু’দিন পরেও বিশাখাপত্তনম শহরের প্রায় ১৮ লাখ নাগরিক এখনও অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন। পানীয় জলের সমস্যা চরমে পৌঁছেছে। সরকারি ব্যবস্থায় জল সরবরাহ তো বন্ধই, যাঁদের বাড়িতে মোটরপাম্প আছে, বিদ্যুৎ না থাকায় তাঁরাও জল তুলতে পারছেন না। প্রশাসন জানিয়েছিল, ট্যাঙ্কারে করে পানীয় জল সরবরাহ হবে। কিন্তু বাস্তবে তেমনটা হয়নি বলে শহরবাসীর অভিযোগ। খোলা বাজারেও জলের দাম আকাশছোঁয়া। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ২০ লিটার জলের ব্যারেল বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। কিন্তু চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ফারাক এত বেশি যে, বাড়তি টাকা দিয়েও বেশির ভাগ জায়গায় জল মিলছে না।
জলের মতোই শহর জুড়ে অপ্রতুল দুধও। দুধের জন্য তাঁর শিশুসন্তানকে নিয়ে শহরের পথে এক মহিলাকে দৌড়তেও দেখা গিয়েছে। দুধের স্টলগুলির সামনে এ দিন সকালেও ছিল বিশাল লাইন। আধ লিটার দুধের প্যাকেট বিকিয়েছে প্রায় দ্বিগুণ দামে, ৫০ টাকায়। বাইরে থেকে শহরে ঢোকার সমস্ত পথঘাট বন্ধ। কাজেই জল হোক বা দুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হোক বা খাদ্যসামগ্রী, কিছুরই জোগান নেই। যেটুকু ব্যবসায়ীদের কাছে মজুদ করা রয়েছে, তা চাহিদার তুলনায় কিছুই না।
শহর জুড়ে বন্ধ এটিএম পরিষেবা। নেটওয়ার্ক না থাকায় এই দুরবস্থা বলে ব্যাঙ্কগুলি জানিয়েছে। তবে এ দিন সকালে বিএসএনএল জানিয়েছে, ১২৫টি মোবাইল টাওয়ারকে সক্রিয় করা সম্ভব হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত আরও ১৫০টি টাওয়ারকে সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে বলে বিএসএনএল জানিয়েছে। মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী অন্য সংস্থাগুলিও পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার চেষ্টায় কাজ করছে।
হুদহুদ-এর সতর্কবার্তা ছড়িয়ে পড়তেই শহরের পেট্রোল পাম্পগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর পর ঝড়ের দাপটে ক্ষতিগ্রস্ত পাম্পগুলি আর খোলেনি। হাতেগোণা কয়েকটি পাম্প সোমবার খুলেছিল। এ দিন আরও কয়েকটি পাম্প খুলতেই সেখানে গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায়। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, পেট্রোল পাম্পগুলি বলতে বাধ্য হয়, অযথা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করার কারণ নেই। তাদের কাছে আগামী ১৫ দিনের জ্বালানি মজুত আছে।
রাস্তায় বিপজ্জনক বিদ্যুত্খুঁটি।
ছবি: পিটিআই।
দুর্গতদের জন্য প্যাকেটে খাবার প্রস্তুত
করা হচ্ছে। ছবি: পিটিআই।
ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় রেলপরিষেবাও স্বাভাবিক হয়নি। তবে রেল সূত্রে খবর, বেশ কিছু জায়গায় রেললাইন এবং ওভারহেড তার মেরামতির পর এ দিন সকাল থেকে কয়েকটি রুটে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়েছে। পরিস্থিতি পুরো স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে বলে সূত্রের দাবি। অন্য দিকে, যে বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিমান এ দিন দুপুরে অবতরণ করে, সেই বিশাখাপত্তনম বিমানবন্দরও বন্ধ রাখা হয়েছে। ভেঙে পড়েছে বিমানবন্দরের একাংশের ছাদ। চতুর্দিকে ছড়ানো রয়েছে উড়ে আসা গাছের ডাল, কাচের টুকরো, জলের বোতল, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং, প্লাইউড বোর্ড। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে মেরামতির কাজ চললেও এই বিমানবন্দর থেকে উড়ান পরিষেবা স্বাভাবিক হতে এখনও সপ্তাহখানেক লাগবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
রাজ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে সোমবারই আকাশপথে ঘুরে দেখেন মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু। পরিস্থিতিকে জাতীয় বিপর্যয় আখ্যা দিয়ে কেন্দ্রের কাছে আর্থিক সাহায্যও চাওয়া হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। মোদী অন্তর্বর্তীকালীন সাহায্য হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে প্রশাসনিক সূত্রে খবর।
বিপর্যস্ত বিশাখাপত্তনম। ছবি: এএফপি।