সংগৃহীত চিত্র।
১৯৫৪ সাল। শ্যামপুকুর স্ট্রিটের মামাবাড়িতে থেকে বড় হওয়া ছেলেটি আর পাঁচ জনের মতই সাধারণ ছিল। উত্তর কলকাতার অলিগলিতে খেলে বেড়ানো সেই ছেলেকে শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। কে জানত, সেই স্কুলের প্রাঙ্গণেই তাঁর স্মৃতিতে গড়ে উঠবে সংগ্রহশালা!
রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছাত্র ও কর্মজীবনের বিভিন্ন ছবি, নথি, তথ্য এবং তাঁর লেখা বই-ও থাকবে এই সংগ্রহশালায়। স্কুলের অন্যতম কৃতী ছাত্রের প্রয়াণের পর তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই স্কুলের এই বিশেষ উদ্যোগ।
শ্যামপুকুর স্ট্রিটের লালবাড়িটি বহু ইতিহাসের সাক্ষী। ১৯২০ থেকে এর পথ চলা শুরু। এর পর পেরিয়েছে ১০৪ বছর। ১৯৫৪-১৯৬১, এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রাথমিক স্তরে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত নানা স্মৃতির ছাপ স্পষ্ট ওই লালবাড়িতে। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে শোকস্তদ্ধ স্কুলের শিক্ষকেরাও।
ছাত্র হিসাবে কেমন ছিলেন তিনি? জানা গিয়েছে, আর পাঁচজনের থেকে আলাদা তো ছিলেনই, নজর কাড়তে পেরেছিলেন তৎকালীন শিক্ষকদের। এই প্রসঙ্গে স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক দেবকুমার বিশ্বাস বলেন, “আমি দু’বছর আগে এই পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তবে প্রাক্তন শিক্ষকদের মুখে মেধাবী ছাত্র হিসাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সুনাম বহুবার শুনেছি। পরবর্তীকালে প্রশাসনিক প্রধান এবং তথ্য প্রযুক্তি দফতরের মন্ত্রী হওয়ার পরও স্কুলের প্রয়োজনে তিনি সবসময় সহযোগিতা করেছিলেন। এমনকি, পরিচয় দেওয়ার সময় স্কুলের নাম বলতে কখনও দ্বিধাবোধ করেননি। আর এটাই স্কুলের কাছে গর্বের বিষয়।”
সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশের পরও স্কুলের কথা ভোলেননি তিনি। ১৯৯৭-এর ২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের মন্ত্রী হিসাবে স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জ্যোতিবিকাশ মিত্রের আবক্ষ মূর্তি উন্মোচনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। এর পর ২০০১ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি স্কুলের প্রতিষ্ঠাদিবসে উপস্থিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানেই তাঁকে প্রধান শিক্ষকের চেয়ারে বসার অনুরোধ জানানো হলেও তিনি তা নাকচ করে দেন। তিনি বলেছিলেন, “ওই চেয়ারে বসার যোগ্যতা আমার এখনও হয়নি।”
প্রাক্তনী হিসাবে বিচারপতি তথা রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল শ্যামল সেন বর্তমানে স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি। তিনি এই সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠার বিষয়ে এক দফা আলোচনা সেরেছেন। একইসঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সাধারণ জীবনযাপনের আদর্শের কথা পড়ুয়াদের জানানোর বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রশাসনিক পদে তো বটেই, সাহিত্যিক হিসাবে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কৃতিত্বের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে শিক্ষনীয়। তাই তাঁর লেখা বই ওই সংগ্রহশালায় রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ছাড়াও, স্কুলের এই তিনটি শ্রেণিকক্ষ ১৭, ১৮ এবং ১৯ নম্বর ঘরে এক সময়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বসেছেন, ক্লাস করেছেন, সেই ঘরগুলিকে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে সাজিয়ে তোলা হবে। প্রতিটি ঘরকে দেওয়া হবে বিশেষ নামও। একটি ঘরকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নামে নামাঙ্কিত করা হবে। সেই ঘরের একটিতে থাকবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীও। তবে তা তাঁর পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষ। ২০২৪-এর ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এই সংগ্রহশালার কাজ সম্পূর্ণ করা হবে।
যতবার তিনি স্কুলে এসেছেন, নিজেকে প্রাক্তন ছাত্র হিসাবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এমনকি, তাঁর দেহরক্ষীদের স্কুলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকত। প্রাক্তন ছাত্রের স্মৃতিতে আবেগতাড়িত স্কুলের বর্তমান অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার হরিনাথ মণ্ডল। তিনি আরও বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বা পুলিশমন্ত্রী হিসাবে নন, ছাত্র হিসাবেই স্কুলের প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকতে ভালোবাসতেন বুদ্ধদেব। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতেন, পুরোনো দিনের স্মৃতি ভেসে উঠত তাঁর আলোচনায়। আমাদের কাছে তা সত্যিই গর্বের।”