নামমাত্র পড়ুয়াদের নিয়ে ধুঁকছে শর্তবর্ষ প্রাচীন স্কুল। নিজস্ব চিত্র।
প্রাথমিক হোক বা উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক— স্কুলে স্কুলে রয়েছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব। তার উপর ছাত্রসংখ্যাও ধীরে ধীরে ঠেকছে তলানিতে। কিছু ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের পঠনপাঠনের জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামোই নেই। আর তাতেই আগ্রহ হারাচ্ছে সরকার পোষিত এবং সরকার অনুমোদিত স্কুলের পড়ুয়ারা।
খাস কলকাতার বুকে নামকরা কিছু স্কুল বাদ দিলে সিংহভাগ স্কুলের ছবিটা একই রকম। শতবর্ষের দোরগোড়ায় থাকা জনপ্রিয় স্কুলেরও করুণ অবস্থা। এমন স্কুলের সংখ্যা ১০০-র গণ্ডি পেরিয়েছে, যেখানে কলকাতায় মোট স্কুলের সংখ্যা ৫০০-র বেশি। স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে তাই স্কুল শিক্ষা দফতর বিশেষ ভাবে তৎপর হয়েছে।
সেই স্কুলগুলিকে চিহ্নিত করেই স্কুল জেলা পরিদর্শকের তরফে বিশেষ বার্তাও পাঠানো হয়েছে। আগামী শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ ২০২৫ থেকে এই ধরনের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা তো বটেই, শিক্ষাকর্মীদেরও স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ করতে হবে। জেলা পরিদর্শকের বার্তায় এ-ও বলা হয়েছে, স্কুলের কর্মীদের পাশাপাশি, স্কুলপড়ুয়াদের অভিভাবক, প্রাক্তন পড়ুয়া এবং স্থানীয় বাসিন্দাদেরও একই ভাবে সহযোগিতা করতে হবে।
কিন্তু সরকারি নিয়ম-নির্দেশিকা প্রকাশের অনেক আগে থেকেই স্কুল বন্ধ হওয়া আটকাতে চেষ্টায় খামতি রাখেননি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। বেলগাছিয়ার শিল্পকলা শিক্ষামন্দির বয়েজ় হাইস্কুলের টিচার ইন চার্জ তথা ইংরেজির শিক্ষক দেবাশিস ঘোষ জানিয়েছেন, ২০০৪-এ যখন তিনি ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন, সেই সময় স্কুলে ছাত্রের সংখ্যা ছিল ১৫০-১৭০। অতিমারি-পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্কুলছুটের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে স্কুলের ছাত্রের সংখ্যা ২০-তে এসে দাঁড়িয়েছে।
একই ভাবে মানিকতলা সংলগ্ন নারকেলডাঙা গার্লস হাইস্কুলের টিচার ইন চার্জ মিঠু বিশ্বাস পান্ডার দাবি, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল হওয়া সত্ত্বেও ৫০০ থেকে ৫০-এর অঙ্কে নেমে এসেছে ছাত্রীদের সংখ্যা। অতিমারি-পরবর্তী আর্থিক সমস্যা তো বটেই, পার্শ্ববর্তী এলাকার অন্যান্য স্কুলে বেশি পড়ুয়া ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
তবে, শুধুই কি অতিমারি-পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে কলকাতার একাধিক স্কুল পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে? জানা গিয়েছে, বাংলা, ইংরেজির মতো বিষয়েই শিক্ষক-শিক্ষিকারা অবসর গ্রহণ করলে সেই শূন্য পদ পূরণের জন্য নতুন করে নিয়োগ করাই হয় না। এমনকি, বেশ কিছু স্কুলে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন বা কম্পিউটার সায়েন্সের মতো বিষয় পড়ানো হলেও কম্পিউটারের হল বা মেশিন নেই!
বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন মণ্ডলের দাবি, সঠিক পরিকাঠামোর অভাব, পুরোনো সিলেবাসেই পঠনপাঠন এবং ভুল সরকারি নীতির ফল ভুগতে হচ্ছে কলকাতা, শহরতলির স্কুলগুলিকে। রাজ্যের বহু নতুন স্কুলও এই একই সমস্যায় ভুগছে। তিনি আরও বলেন, “এই স্কুলগুলিকে বাঁচাতে হলে নিয়মিত শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগ যেমন জরুরি, তেমনই বিকল্প পঠনপাঠনের মাধ্যমকেও উৎসাহ দিতে হবে।”
এ তো গেল পরিকাঠামোগত সমস্যা। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা, বৃত্তিমূলক বিষয়ে চর্চা বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে একই স্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কলকাতার মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলি পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। ভবিষ্যতে পেশা প্রবেশের স্বার্থে সরকার অনুমোদিত বা সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা না-হওয়ায় বেসরকারি স্কুলগুলিতেই ভর্তি করার চেষ্টা করেন অভিভাবকেরা। যাঁরা আর্থিক ভাবে সচ্ছল নন, তাঁরাও চেষ্টা করেন একটু জনপ্রিয় সরকারি স্কুলে ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করাতে। ফলত, এলাকায় থাকা অন্য স্কুলগুলিকে পড়ুয়াদের অভাবে কার্যত ধুঁকতে হচ্ছে।
শিক্ষামহলের একাংশের অভিযোগ, স্কুল শিক্ষা দফতরের কাছে এই সমস্যাগুলি অজানা নয়। তবুও এর সমাধান কী ভাবে সম্ভব, তার উত্তর নেই কারও কাছেই। তাই কলকাতার এক অংশের কিছু স্কুল যেখানে ভাল ফলের জন্য বছরের পর বছর প্রশংসিত হয়ে চলেছে, সেখানে কিছু স্কুল স্রেফ অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে কোনও ক্রমে মাটি আঁকড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।