তখন প্রস্তুতিপর্ব। নরেন্দ্র মোদী ও অরুণ জেটলি। অক্টোবর ২০১৩।
কেন্দ্রীয় বাজেটে ‘আর্থিক সংস্কার’-এর কী রূপরেখা অর্থমন্ত্রী পেশ করেন, তা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে স্বভাবতই একটা উত্সাহ তৈরি হয়েছিল। বাজেট যদিও মূলত সরকারি আয়ব্যয়ের হিসেবনিকেশ, কিন্তু আমাদের দেশে বাজেট থেকে সরকারি নীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে অনেক সময় কিছুটা ধারণা করা যায়। যেহেতু অনেক দিন পরে কেন্দ্রে নতুন সরকার এসেছে এবং প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি শিল্পবাণিজ্যের অনুকূল বলে সুপরিচিত, সুতরাং এ বারে প্রত্যাশা কিছুটা বেশিই ছিল।
মূল্যস্ফীতির হার যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, একটা সুস্থিত কর ও শুল্ক নীতি চালু করা হয় এবং সরকারি জমাখরচের খাতায় কিছুটা শৃঙ্খলা আনা যায়, তবে বিনিয়োগ উত্সাহিত হতে পারে। বস্তুত, কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় ২০১৪-১৫ সালে ৫.৫ শতাংশ আয়বৃদ্ধির প্রত্যাশা করা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এ বারের বাজেটের এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক কর্মসূচির কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করব।
ভূতপূর্ব ইউপিএ সরকারের অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম ২০১৪-১৫’র অন্তর্বর্তী বাজেটে ফিসকাল ডেফিসিট বা রাজকোষ ঘাটতির হার জিডিপির ৪.১ শতাংশে বেঁধে রাখতে চেয়েছিলেন। নতুন এনডিএ সরকারের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সেই লক্ষ্যমাত্রাই বজায় রেখেছেন। এটা একটু আশ্চর্যেরই বটে, কারণ বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের এবং জেটলির নিজেরও ধারণা যে, এই লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হবে। তবে আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত ঘাটতি বেঁধে রাখতে জেটলি হয়তো সক্ষম হবেন। তার একটা কারণ হল, ইতিমধ্যেই অর্থবর্ষের সাড়ে তিন মাস চলে গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রক নানা প্রকল্প তৈরি করতে করতে আরও কয়েক মাস কেটে যাবে, সুতরাং বরাদ্দ অর্থের অনেকটাই সম্ভবত বছরের শেষে অব্যবহৃত থাকবে। তা ছাড়া, শেয়ার বাজার যে রকম তেজী, তাতে বিলগ্নিকরণ বাবদ অর্থমন্ত্রী তাঁর প্রস্তাবিত প্রায় ৬৫০০০ কোটি টাকা তুলে ফেলতে পারবেন বলেই মনে হয়, এমনকী প্রাপ্তি তার বেশিই হতে পারে। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি থেকে লভ্যাংশও তাঁর অনেকটা প্রয়োজন মেটাতে পারে।
আরও বড় দুশ্চিন্তা হল রেভিনিউ ডেফিসিট বা রাজস্ব খাতে ঘাটতি নিয়ে। বাজেটে ধরে নেওয়া হয়েছে, চলতি অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতি হবে জিডিপির ২.৯ শতাংশ। রাজস্ব ঘাটতি মানে এই যে, সরকারের ভোগব্যয়ই তার আয়ের চেয়ে বেশি, অর্থাত্ সে ব্যয়ের কিছুটা তাকে পুঁজি ভেঙে বা ধার করে মেটাতে হচ্ছে। সুতরাং রাজস্ব খাতে ঘাটতির বদলে উদ্বৃত্ত থাকা বা অন্তত ঘাটতি শূন্য হওয়া দরকার। সরকার ঋণ নেবে, তাতে কোনও ক্ষতি নেই, কিন্তু সেই ঋণের টাকায় ভোগব্যয় করা উচিত নয়, তা দিয়ে নতুন বিনিয়োগ করা বিধেয়। অর্থমন্ত্রীকে রাজস্ব ঘাটতি ক্রমশ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতেই হবে, সেটা কঠিন কাজ। এই সূত্রেই ব্যয়সংকোচের, বিশেষ করে ভর্তুকি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন উঠবে। অরুণ জেটলির বাজেট ভাষণে এ বিষয়ে বিশদ কিছু বলা হয়নি, কেবল জানানো হয়েছে, ভর্তুকি সহ সব রকমের সরকারি ব্যয় খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করা হবে। তবে ভর্তুকি যাঁদের প্রাপ্য তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য সরকার তত্পর হতে পারে, সে ক্ষেত্রে অপাত্রে দানের মাত্রা কমবে, খরচেরও সাশ্রয় হবে। সেটা বাজেটে বলার ব্যাপার নয়, যদিও তার সুফল বাজেটের ওপর পড়বে।
বাজেটে বিভিন্ন শিল্প-উপকরণের ওপর আমদানি শুল্ক রদ করে শিল্পকে উত্সাহ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (সেজ) এবং বড় আকারের শিল্প-গুচ্ছকে নতুন করে উত্সাহিত করার কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এ-সবই শিল্পের অনুকূল। সরকার নাকি কিছু কিছু রাজ্যে শিল্প-পার্ক নির্মাণে চিনা বিনিয়োগে উত্সাহ দিতে চায়।
অর্থমন্ত্রী প্রতিরক্ষা ও বিমায় বিদেশি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে ২৬ থেকে ৪৯ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। অস্ত্র আমদানিতে ভারত পৃথিবীতে সবার আগে। প্রতিরক্ষার সরঞ্জাম দেশে তৈরি করতে পারলে বিদেশি মুদ্রার খরচ কমবে, কর্মসংস্থানও বাড়বে, বাড়বে সরকারি রাজস্বও। কিন্তু প্রতিরক্ষা শিল্পের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রেখে দিলে বিদেশি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি কতটা সত্যিই আসবে, সে বিষয়ে সংশয় আছে। অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে সচেতন, কিন্তু তিনি বিভিন্ন সাক্ষাত্কারে জানিয়েছেন, ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বিদেশি উদ্যোগীকে সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকানা বা পরিচালনার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেওয়া কঠিন। মনে রাখতে হবে, সঙ্ঘ পরিবারের মধ্যেই ‘স্বদেশি’র প্রবক্তারা প্রবল। অন্য দিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বিমা কোম্পানি এবং কোল ইন্ডিয়ার মতো সংস্থাগুলিতে সরকারি মালিকানার অনুপাত ৫১ শতাংশের নীচে নামাতে গেলে সংসদে বিল পাশ করাতে হবে। সেটা এখন কঠিন কাজ, কারণ রাজ্যসভায় এনডিএ-র সংখ্যার জোর নেই। প্রসঙ্গত, রেল বাজেটেও বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব আছে, যদিও এ বিষয়ে বিশদ করে কিছু বলা হয়নি।
বিনিয়োগ এবং শিল্পপ্রসারের পথে সমস্ত বাধা শুধু বাজেট দিয়েই দূর করা যাবে, এটা অবশ্যই কেউ আশা করেন না। যেমন, সাম্প্রতিক জমি অধিগ্রহণ আইন সম্পর্কে শিল্পোদ্যোগীদের নানা আপত্তি আছে। তাঁরা মনে করেন, এই আইন জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াকে অস্বাভাবিক বিলম্বিত করে তুলবে। তা ছাড়া, অরণ্য আইন এবং পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র পেতে দেরি হওয়ার ফলেও অনেক প্রকল্প দীর্ঘ দিন আটকে আছে। শ্রম আইনের জটিলতা ও ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধও শিল্পের একটা সমস্যা। কিন্তু এ সবের সমাধান অর্থ মন্ত্রকের হাতে নেই। পরিকাঠামোর সমস্যাও বিস্তর, যথা, খারাপ রাস্তা, বন্দরে মাল খালাসে দেরি, রেল ওয়াগনের অভাব, কয়লা ও বিদ্যুত্ সরবরাহে অনিশ্চয়তা। পরিকাঠামোর উন্নতিসাধনে অর্থ বরাদ্দ অর্থমন্ত্রীর কাজ, বস্তুত এই বাজেটে পরিকাঠামোর বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে সেচ বা হিমঘরের মতো কৃষি-পরিকাঠামোয় অনেকটা অর্থই বরাদ্দ করা হয়েছে, কিন্তু অর্থ বরাদ্দ হলেই পরিকাঠামো হয় না।
সব কিছু বাজেটে ঘোষণা না করে বা বেশি ঢাকঢোল না পিটিয়ে সরকার অনেক পরিবর্তন আনতে পারে। যেমন, চিদম্বরম উত্পাদন শুল্কে যে সব ছাড় দিয়েছিলেন, সেগুলির মেয়াদ চুপচাপ ডিসেম্বর অবধি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার, রেল বাজেটের আগেই যাত্রিভাড়া ও পণ্য-মাসুল বাড়ানো হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, ডিজেলের মতোই রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রেও নিয়মিত অল্প অল্প করে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমানো হতে পারে। রাজস্থানে বিজেপি সরকার রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও শ্রম আইন সংশোধনে উদ্যোগী হয়েছে। তারা সফল হলে অন্য রাজেও এমন উদ্যোগ দেখা যেতে পারে। আইন মন্ত্রক জমি অধিগ্রহণ আইন সংশোধনের চেষ্টা শুরু করতে পারে। আধার কার্ড সম্পর্কে মোদী সরকারের প্রাথমিক আপত্তি থাকলেও এখন শোনা যাচ্ছে, খাদ্য, সার, রান্নার গ্যাস এবং কেরোসিনের ক্ষেত্রে প্রাপকের হাতে ভর্তুকির টাকা সরাসরি তুলে দেওয়ার জন্য সরকার আধার কার্ড বা অনুরূপ কোনও পরিচয়পত্রের সাহায্য নিতে পারে। এমনকী খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে অনুমতি দেওয়ার সম্ভাবনাও অর্থমন্ত্রী পুরোপুরি নাকচ করেননি, তিনি আপাতত বলেছেন, আগে অন্য সহজতর ক্ষেত্রে সংস্কারের কাজ হোক, তার পর জটিল ব্যাপারগুলি নিয়ে ভাবা যাবে। বস্তুত, কোনও বিদেশি কোম্পানি ভারতে কিছুটা উত্পাদন করলে তাকে এ দেশে মাল্টিব্র্যান্ড ই-রিটেলিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, এর পরিধি ক্রমশ প্রসারিত হতে পারে।
হয়তো বলা চলে, সরকার ‘অলক্ষ্যে সংস্কার’-এর পথ বেছে নিতে চায়। আমাদের মতো শোরগোলপ্রবণ অস্থির গণতন্ত্রে সেটা বিচক্ষণতার পরিচায়ক হতে পারে।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট কলকাতা’য় অর্থনীতির ভূতপূর্ব শিক্ষক।