সম্পাদকীয় ২

স্বাধীনতার শত্রু

যত বদলায়, ততই এক থাকিয়া যায়। কথাটি প্রাচীন, তাহার তাৎপর্য আজও সমান গভীর। হয়তো বা গভীরতর। ক্যালেন্ডারের পাতায় বছর বদলাইবে, ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার ধারা বদলাইবে না। সেই ধারার অনুসারীরা বলিবেন: যাহা আমার পছন্দ নহে, আমি তাহা চলিতে দিব না। এবং বলিয়াই নিরস্ত হইবেন না, ভীতিপ্রদর্শন হইতে ভাঙচুর, অপরের স্বাধীনতা হরণের সমস্ত উপায়ই অনুসরণ করিবেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৪
Share:

যত বদলায়, ততই এক থাকিয়া যায়। কথাটি প্রাচীন, তাহার তাৎপর্য আজও সমান গভীর। হয়তো বা গভীরতর। ক্যালেন্ডারের পাতায় বছর বদলাইবে, ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতার ধারা বদলাইবে না। সেই ধারার অনুসারীরা বলিবেন: যাহা আমার পছন্দ নহে, আমি তাহা চলিতে দিব না। এবং বলিয়াই নিরস্ত হইবেন না, ভীতিপ্রদর্শন হইতে ভাঙচুর, অপরের স্বাধীনতা হরণের সমস্ত উপায়ই অনুসরণ করিবেন। সংবিধান অবাধ মতপ্রকাশের অধিকার মঞ্জুর করিয়াছে, কিন্তু তাহাতে এই মতান্ধ উগ্রবাদীদের কিছু যায় আসে না, তাঁহারা অন্য সংবিধানে বিশ্বাস করেন। সেখানে ভিন্নমত সম্পর্কে একটিই নিদান দেওয়া আছে: মারো।

Advertisement

রাজকুমার হিরানির ‘পিকে’ চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী সেই নিদান জারি করিয়াছে এবং তাহা কার্যকর করিতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছে। তাহাদের অভিযোগ: এই ছবিতে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসীদের অপমান হইয়াছে। কাহার কীসে অপমান হয়, তাহারও সর্বজনগ্রাহ্য কোনও নিয়ম নাই। ধর্মবিশ্বাসীরা নিশ্চয়ই কোনও কারণে অপমানিত বোধ করিতে পারেন, সেই অধিকার তাঁহাদের আছে, ঠিক যেমন ধর্মে অবিশ্বাসীদেরও আছে। অপমানিত বোধ করিলে তাঁহারা গণতান্ত্রিক এবং সভ্য উপায়ে প্রতিবাদও করিতে পারেন। বস্তুত, সাহিত্য, শিল্প, নাটক, চলচ্চিত্র বা অন্য যে কোনও শিল্পকীর্তি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষে অপমানজনক কি না, তাহা লইয়া প্রবল যুক্তিতর্ক চলিতে পারে, সেই তর্কের মন্থন হইতে সমাজ-সংস্কৃতি ঋদ্ধ হইতে পারে। কিন্তু যাঁহারা ‘এই সিনেমা দেখানো চলিবে না’ বা ‘এই সব অধার্মিককে বহিষ্কার করিতে হইবে’ বলিয়া তাণ্ডব করিতে চাহেন, তাঁহারা স্পষ্টই অন্য গোত্রের জীব। যুক্তিতর্কের স্বাধীন উদার পরিবেশ তাঁহাদের সহ্য হয় না, সেই পরিবেশ ধ্বংস করিয়াই তাঁহারা আধিপত্য জারি করিতে চাহেন। স্বাধীনতা তাঁহাদের শত্রু। তাঁহারা স্বাধীনতার শত্রু।

ইহা কোনও সমাপতন নহে যে, এই ধরনের অসহিষ্ণুতা সচরাচর ধর্মাশ্রিত সংগঠনকে আশ্রয় করিয়া লালিত হয়। এবং এ বিষয়ে কোনও একটি বিশেষ ধর্মমতকে দায়ী করিলে অন্যায় হইবে। ইতিহাস জুড়িয়া বিভিন্ন ধর্মের অনুগামীদের এই পরমত-দমনের অজস্র নিদর্শন ছড়াইয়া আছে। বহুচর্চিত সেই ইতিহাসের কাসুন্দি ঘাঁটিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, গুরুত্বপূর্ণ কথা একটিই: কোনও যথার্থ গণতন্ত্র এই ধরনের অসহিষ্ণুতাকে মানিতে পারে না। যে ধর্মের দোহাই পাড়িয়া যে শিবির হইতেই এমন জঙ্গি দাপট দেখাইবার চেষ্টা করা হোক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাজ তাহার মোকাবিলায় তৎপর হওয়া। গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দুত্ববাদের ধ্বজাধারীদের যে বর্ধিত অসহিষ্ণুতা দেখা গিয়াছে, জঙ্গি ভাষণ ও উপদ্রবের যে জোয়ার আসিয়াছে, তাহাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, তাহারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হইতে দুঃসাহস সংগ্রহ করিতেছে। এই দুঃসাহস সমূলে বিনাশ করা শাসকদের নৈতিক দায়িত্ব। গণতন্ত্রের প্রতি দায়িত্ব। সংবিধানের প্রতি দায়িত্ব। ‘পিকে’ প্রদর্শনে অগণতান্ত্রিক বাধা দূর করাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কর্তব্য। সেই কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হইলে তাহাই হইবে রাজধর্মের অপমান। নরেন্দ্র মোদী নিশ্চয়ই জানেন, তিনি সঙ্ঘ পরিবারের প্রচারক নহেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, এবং রাজধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্ম লইয়া মাথা ঘামানোর কোনও নৈতিক অধিকার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাই।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement