প্রবন্ধ ২

শ্রমিককে বাদ দিয়ে শিল্প দাঁড়াবে কী করে

কিছু দিন আগে হুগলির নর্থব্রুক চটকলের ভিতর কর্মীদের হাতে এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের মৃত্যুর পর রাজ্যের সার্বিক শিল্প-পরিস্থিতি আবার প্রশ্নের মুখে। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, চটকলে জঙ্গি আন্দোলনের দিন হয়তো বা আবার ফেরত আসছে। গত চোদ্দো বছরে রাজ্যের বিভিন্ন চটকলে ম্যানেজমেন্টের বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ কর্মী শ্রমিকদের আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন। নর্থব্রুকের ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় ‘চেন রি-অ্যাকশন’-এর মতো বেশ কয়েকটি চটকলে তালা পড়েছে, কাজ হারিয়েছেন বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৪ ০০:৩৯
Share:

কিছু দিন আগে হুগলির নর্থব্রুক চটকলের ভিতর কর্মীদের হাতে এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের মৃত্যুর পর রাজ্যের সার্বিক শিল্প-পরিস্থিতি আবার প্রশ্নের মুখে। অনেকে আশঙ্কা করছেন যে, চটকলে জঙ্গি আন্দোলনের দিন হয়তো বা আবার ফেরত আসছে। গত চোদ্দো বছরে রাজ্যের বিভিন্ন চটকলে ম্যানেজমেন্টের বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ কর্মী শ্রমিকদের আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছেন। নর্থব্রুকের ঘটনার কিছু দিনের মধ্যেই প্রায় ‘চেন রি-অ্যাকশন’-এর মতো বেশ কয়েকটি চটকলে তালা পড়েছে, কাজ হারিয়েছেন বেশ কয়েক হাজার শ্রমিক। ফলত ইতিমধ্যেই ধুঁকতে থাকা পাটশিল্পের অবস্থা আরও সঙ্গিন।

Advertisement

খুনের ঘটনাকে কোনও যুক্তি দিয়েই বিন্দুমাত্র সমর্থন করা যায় না। রাজ্যের চটকলের সামগ্রিক সমস্যাও অবশ্যই জটিল। কিন্তু সাধারণ ভাবে চটকল শ্রমিকদের অবস্থাটা কী, সেটাও বোধহয় একটু খেয়াল রাখা ভাল। সরকারি তথ্যই বলছে, প্রতি বছর গড়পড়তা দশ হাজার চটকল শ্রমিক কাজ করতে করতে দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হন। মৃত্যুর হিসেব নিলে ২০০৬ থেকে ২০১০-এ ৩৮ জন আর ২০১১-১৩ মার্চ পর্যন্ত ১৮ জন। রাজ্যের এগারো হাজারের কাছাকাছি নথিভুক্ত কারখানায় প্রতি বছর যত দুর্ঘটনা হয়, তার অর্ধেকের বেশি হয় গোটা পঞ্চাশেক চটকলে। গড়পড়তা বছরে প্রতি কুড়ি জন চটকল শ্রমিকের মধ্যে এক জন দুর্ঘটনার শিকার।

এ বার এই সরকারি তথ্যের সঙ্গে বেসরকারি তথ্য যোগ করা যাক। রাজ্যের চটকলগুলিতে যদি দু’লক্ষের উপর শ্রমিক সরকারি ভাবে কাজ করেন, তবে সম্ভবত আরও এক লক্ষ শ্রমিক কাজ করেন তালিকায় নাম না তুলেই। যেমন, চটকলে ‘ভাগাওয়ালা’ বলে একটি প্রথা আছে, যেখানে খাতায় নাম থাকা কর্মী নিজের বদলে অন্য কাউকে কাজে লাগান। এই বর্গের কর্মীদের কোনও দুর্ঘটনা হলে তাঁরা আগের দেওয়া হিসাবে ঢোকেনও না, কোনও ক্ষতিপূরণও পান না। এই তাৎক্ষণিক বিপদের বাইরে আছে চটকলের মধ্যে অসম্ভব দূষিত পরিবেশে বহু দিন কাজ করার ফলে হওয়া নানান রোগব্যাধি। এ বিষয়ে কোনও বিশদ প্রামাণ্য নথি না থাকলেও চটশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষের অভিযোগ যে, ক্যানসার, বধিরতা আর চোখের সমস্যা শ্রমিকদের মধ্যে হরবখত পাওয়া যায়।

Advertisement

বিভিন্ন দলের শ্রমিক ইউনিয়নের নেতানেত্রী থেকে সরকারি উচ্চপদস্থ আধিকারিক, যাঁরা নীতিনির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা নেন বা চটশিল্প নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেরই ধারণা নেই যে, চটশিল্পে এমন বিপুল পরিমাণ দুর্ঘটনা নিয়মিত হয়ে চলেছে, দূষণের ফলে হওয়া শারীরিক অসুস্থতার খবর রাখা তো দূরস্থান। সম্প্রতি কিছু দিন ধরে বিভিন্ন নেতানেত্রীর কাছে যখনই এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, গড়পড়তা উত্তর ছিল: ‘কত হবে? বছরে শ’খানেক বা দুয়েক’। আলোচনায় আর একটি অদ্ভুত বিষয় উঠে এসেছে। চটকল মালিক বা তাঁদের প্রতিনিধিরা তো বটেই, মন্ত্রী থেকে শুরু করে বহু শ্রমিক নেতাও অভিযোগ তুলেছেন যে, শ্রমিকদের অনেকেই ‘ইচ্ছা করে’ আঙুল কেটে বা অন্যান্য দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার চেষ্টা করেন মেয়ের বিয়ে বা ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে। কতটা সত্যি, বলা কঠিন। কিন্তু শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ‘উদীয়মান ভারত’-এর শ্রমিককে মেয়ের বিয়ে বা ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে ‘ইচ্ছে করে’ আঙুল কাটতে হচ্ছে বা দুর্ঘটনা ঘটাতে হচ্ছে! এবং যাঁরা রাজ্য চালান, শ্রমিকদের ভালমন্দ দেখেন বলে দাবি করেন, তাঁরা তা জানিয়ে দুর্ঘটনার সাফাই গাইছেন!

কেন এত দুর্ঘটনা, যা দেশের মধ্যেও রেকর্ড সৃষ্টি করে চলেছে? কারণ অনেক। চটকলকর্মী ও তাঁদের জীবিকা, কাজের পরিবেশ নিয়ে বহু দিন ধরে কাজ করছেন নাগরিক মঞ্চ। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম কারণ যদি হয় প্রাগৈতিহাসিক চটকলগুলির আধুনিকীকরণ না হওয়া, দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই ক্রমাগত কর্মীদের ওপর শারীরিক চাপ বৃদ্ধি পাওয়া। আধুনিকীকরণ না করা, মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন দু’তরফের পক্ষেই সুবিধাজনক। আধুনিকীকরণ করলে ছাঁটাই বাড়বে, তাতে ইউনিয়নের সমস্যা। আর, কারখানা যেমন আছে তেমন রাখলে মালিকের খরচ কম। মনে রাখতে হবে, চটশিল্পের প্রায় পুরোটাই সরকারি বরাতের বাঁধাধরা বাজার। সরকার অর্ডার দেবে, আমি বস্তা তৈরি করব আর লাভ করব। সহজ সমীকরণ। বাজারের চাপ নেই, প্রতিযোগিতা নেই, খামখা পয়সা খরচ করে আধুনিকীকরণ করবে কে? চটকলে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার প্রায় অর্ধেকই হয় এই সব প্রাগৈতিহাসিক মেশিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে। রাজ্যের যে সতেরোটির মতো চটকল কিছুটা হলেও আধুনিকীকরণ করেছে, সেখানে সমস্যা অনেক কম।

পাশাপাশি, চটকলগুলিতে কাজের সাপেক্ষে শ্রমিকসংখ্যার অনুপাত ক্রমেই কমেছে। নব্বই দশকের গোড়ায় এক টন পাটের ‘প্রসেসিং’ করতে ৬৫ জনের মতো শ্রমিক লাগত, এখন সংখ্যাটা ২০-২২-এ নেমেছে। অধুনা তৃণমূল সাংসদ, তৎকালীন আধিকারিক দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সমীক্ষা করে দেখেছিলেন যে, সংখ্যাটি ৩৯ জনের চেয়ে কোনও মতেই নামানো যায় না। ফলে আগে তিন জন শ্রমিক যে কাজ করতেন, এখন এক জনকে প্রায় সেই কাজ করতে হয় লুম-এ দড়ি লাগানো থেকে শুরু করে সারাক্ষণ বাতাসে ওড়া পাটের আঁশ পরিষ্কার করা। বহু ক্ষেত্রেই আট ঘণ্টার নিয়ম ভেঙে দশ-এগারো ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো হয়। অনেক সময় প্রয়োজনে শৌচালয়ে যাবারও অনুমতি মেলে না। প্রায় চুল্লি সদৃশ গরমে, গগনভেদী আওয়াজে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে যাঁরা দিনের পর দিন এমন কাজ করেন, তাঁদের তো দুর্ঘটনা না হওয়াই অস্বাভাবিক! এর ওপর আছে আর্থিক নিরাপত্তার অভাব। এক নিকট আত্মীয় চটকলে কাজ করার সুবাদে দেখা, কী ভাবে কর্মীরা ‘কাল সকালে চটকল খোলা থাকবে কি না’ সেই সংশয়ে ভোগেন। কী ভাবে না-পাওয়া মাইনের তালিকা এক মাস ছাড়িয়ে তিন মাস বা বছরে পৌঁছে যায়। এর পর আছে অবসরকালীন সুবিধা না পাওয়া। কেউ বলেন কয়েকশো, কারও মতে কয়েক হাজার কোটি টাকার গ্র্যাচুইটি বাকি পড়ে আছে চটকলগুলিতে। মালিকদের পাশাপাশি সরকারের দায়িত্বও কম নয়। মালিকদের নিয়ম না মানানোর পাশাপাশি তারা নিজেরাও নিয়ম ভাঙে নিয়ম করে। কারখানার পাশাপাশি কুলি-লাইনগুলিতে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। শৌচালয় উপচে পড়ছে, ভয়ানক দুর্গন্ধ, উদরাময় লেগেই আছে, যখন-তখন বিদ্যুতের লাইন কাটা...। সরকারি তদারকি? ২০১২-এর জানুয়ারি থেকে ২০১৩-র মার্চ এই চোদ্দো মাসে সরকারি ইনস্পেক্টররা নাকি চটকলগুলির মধ্যে ধুলো নিয়ে ১৬১টি, শৌচালয় সংক্রান্ত ১৫৮টি, পানীয় জল বিষয়ে ১২৪টি, যথাযথ আলো না থাকার বিষয়ে ১১টি ‘অপরাধ’ লিপিবদ্ধ করেছেন।

এটা না হয় না-ই ধরলাম যে, অভিযোগগুলির ধরন জানলে মনে হয় অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতাব্দীর কথা হচ্ছে। কিন্তু অপরাধগুলির জন্য ‘অপরাধী’দের কী শাস্তি হয়েছিল, কারও জানা নেই। উত্তর নেই, কেন দশ বছর আগে সমস্যাসঙ্কুল কারখানায় জীবিকা সংক্রান্ত শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার স্পষ্ট নির্দেশিকা দেওয়া সত্ত্বেও এ রাজ্যে আজ পর্যন্ত তার প্রচলন হয়নি? কেনই বা আদালতের নির্দেশে সমীক্ষা করে ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ’ রাজ্যের বহু কারখানার (চটশিল্প সমেত) পরিবেশই কাজের জন্য একেবারেই ঠিক নেই জানানো সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত না মালিক, না ইউনিয়ন, না সরকার কেউ ফিরে তাকানোর কোনও প্রয়োজনই বোধ করলেন না!

শুধু চটকল নয়, গোটা রাজ্যের যাবতীয় কারখানা ধরলে গত আঠারো বছরে সাড়ে তিন সরকারের আমলে (তিনটি বামফ্রন্ট ও অর্ধেক তৃণমূল) প্রায় পাঁচ লক্ষ শ্রমিক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ও বিপন্ন হয়েছেন, যার মধ্যে ১১০০-এর উপর মারা গেছেন। বেআইনি, সরকারি তালিকার বাইরে থাকা কর্মী আর কারখানায় দূষণের ফলে আক্রান্ত শ্রমিক ধরলে সংখ্যা কোন নবান্নের ছাদ ছাড়াবে, কে জানে? শ্রমিকদের শিক্ষা, সচেতনতা বাড়ানোর নিশ্চয়ই প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে আন্দোলনকে ঠিক দিশা দেওয়ার। কিন্তু এই পাঁচ লক্ষাধিক শ্রমিকের কাজ করার ন্যূনতম পরিবেশ এবং জীবন-সংস্থানটুকু না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি কীসের ওপর দাঁড়াবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement