উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁর ঘটনা আবার প্রমাণ করল, ধর্ষণ আসলে ক্ষমতার একটি হুঙ্কার। ধর্ষণের সঙ্গে সহসা কাম জেগে ওঠা কিংবা প্রবৃত্তির তাড়নার কোনও সম্পর্ক সচরাচর নেই। ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতন নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের একমাত্রিক আস্ফালনমাত্রও নয়। অন্তত এ দেশে তো নয়ই। এই অত্যাচারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে থাকে আরও অনেক সামাজিক বাস্তব, যেমন জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, রাজনৈতিক রং এবং শ্রেণির ক্ষমতা।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই বহুমাত্রিক ক্ষমতার আলাদা আলাদা চেহারা দেখা যায়। কোথাও নারী শরীরের ওপর শক্তি জাহির করার এই দুরভিসন্ধি জাত-ধর্মের ক্ষমতার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে, কোথাও অর্থের প্রতিপত্তির সঙ্গে, কোথাও বা রাজনৈতিক বলের সঙ্গে। কোথাও কোথাও আবার অনেকগুলি ক্ষমতা একসঙ্গে দৌরাত্ম্য চালায়। বদায়ূঁর কাটরায় যেমন নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্যের সঙ্গে উচ্চবর্ণের ক্ষমতা হাত মিলিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে হামেশাই রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রকাশের ক্ষেত্র হয় নারীশরীর। তেমনই ২০০২-এর গুজরাতে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর ক্ষমতা, রাষ্ট্রের ক্ষমতা এবং পিতৃতন্ত্রের ক্ষমতা মিলেমিশে সংখ্যালঘু মেয়েদের ওপর নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল, ক্ষমতার এই ন্যক্কারজনক প্রকাশ বন্ধ করার বা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপায় কী? ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এ বারের নির্বাচনী প্রচারের সময় দেশে যথেষ্ট শৌচালয় গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেই প্রতিশ্রুতির সূত্র ধরে অনেকেই মনে করছেন, ‘শৌচালয়’ ধর্ষণ থামানোর অন্যতম উপায়। এই কথাটা শুনলে অদ্ভুত লাগে, চিন্তাও হয়। হতে পারে, ভোররাতে অন্ধকারে শৌচকার্য সারতে গিয়ে বহু মেয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হন।
পথেঘাটে ধর্ষণের সম্ভাবনা কমানোর জন্য কয়েকটি বাস্তব ব্যবস্থা সত্যিই জরুরি। রাস্তায় আলো, ঘন ঘন নিরাপদ পরিবহণ, সাহায্যকারী ফোন নম্বর, সক্রিয় এবং সংবেদনশীল পুলিশ-প্রশাসন ইত্যাদি। এই পরিকাঠামোর তালিকায় শৌচালয়ও যুক্ত হতে পারে। কিন্তু একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলা দরকার। সেটা এই যে, এই ব্যবস্থাগুলোর সঙ্গে প্রয়োজন রাষ্ট্রের, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এবং তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মূল্যবোধের একটা মৌলিক এবং স্থায়ী পরিবর্তন।
কেমন হওয়া দরকার সে মূল্যবোধ? যা মেয়েদের শুধু সুরক্ষার পাত্রী হিসেবে দেখে না, স্বাধীনতার অধিকারী হিসেবে দেখে। যে মূল্যবোধ মেয়েদের নিরাপত্তা মানে মেয়েদের রাতবিরেতে ঘরের বাইরে পা রাখতে আটকায় না, মেয়েদের সালোয়ার কামিজে আপাদমস্তক ঢাকতে বলে না অথবা সর্বদা পুরুষ দেহরক্ষী নিয়ে ঘুরতে বলে না। যে মূল্যবোধ সারাক্ষণ মেয়েদের দোষ ধরে না।
মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য শৌচালয় প্রকল্প চাই এ দাবি শুনলে চিন্তা হয় যে, এই দাবিকে কেউ মেয়েদের আরও বেশি করে ঘরে ঢোকানোর যুক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করে নিতে পারেন। বলতে পারেন, ‘ঠিকই তো, শৌচালয়ের ব্যবস্থা না থাকলে মেয়েদের বাইরে বেরোনো উচিত নয়।’ মেয়েদের যে কোনও সময়ে, যে কোনও জায়গায় চলাফেরার অধিকারকে খর্ব করার যে তাগিদ আমাদের সমাজে প্রবল, এই দাবি প্রকারান্তরে তার সাফাই হয়ে উঠবে না তো?
আর, মেয়েরা ভোররাতে শুধু শৌচকার্য করতেই পথে বেরোন না। যে মেয়ে গ্রাম থেকে সব্জি নিয়ে শহরের বাজারে আসেন বা রাত তিনটেয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভোর ছ’টায় বাবু-বাড়ি কাজে যান, তাঁকেও ভোররাতে বেরোতে হয়। বছর দেড়েক আগেই কলকাতার রাস্তায় ভোরবেলা কাজে যাওয়ার পথে ধর্ষিত হয়েছিলেন এক গৃহশ্রমিক।
শৌচালয়ের প্রয়োজন নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই অবশ্যই। ঘরে ঘরে শৌচালয় প্রয়োজন। প্রয়োজন রাস্তাঘাটে হাতের নাগালে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন শৌচাগার। কিন্তু সেটা স্বাস্থ্যের জন্য, পরিবেশের জন্য, পরিচ্ছন্নতার জন্য। শৌচালয় দিয়ে মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। এবং, শৌচালয় হলে ধর্ষণ আটকানো যাবে এই ধারণাটা কোথাও একটা ধর্ষণের অপরাধকে ছোট করে দেখানোয় সামাজিক প্রবণতায় উত্সাহ দিতে পারে। ভয়টা এই কারণেই।
এখানেই আর একটা কথা ওঠে। সাধারণ ভাবে, মেয়েদের ‘সুরক্ষা’ দিলেই তাদের বিরুদ্ধে হিংসা বা অত্যাচার কমবে, এই ভাবনায় একটা সমস্যা আছে। শুধুমাত্র সুরক্ষা দিয়ে যৌন অত্যাচার কখনওই বন্ধ হবে না। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ঘরের মধ্যেও যৌন নির্যাতন কিছু কম হয় না। তা ছাড়া, যদি সুরক্ষা দিয়েই যৌন নির্যাতন বন্ধ করা যেত, তা হলে গত ২ জুন দুষ্কৃতীরা আলিগড়ে চূড়ান্ত সুরক্ষিত বিচারকের বাড়িতে ঢুকে তাকে নির্যাতনের সাহস পেত না।
তাই শেষ পর্যন্ত কঠিন কথাটা কঠিন করে বলাই ভাল। সুরক্ষার ছলে মেয়েদের লক্ষ্মণরেখায় বন্দি করে যৌন অত্যাচার, খুন, বন্ধ করার আশা দুরাশা মাত্র। যৌন নির্যাতন সত্যিই বন্ধ করতে হলে আগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের ক্ষমতার সোপানগুলিকে ভাঙা দরকার। জাত, ধর্ম, অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং পুরুষ আধিপত্যের যোগসাজশ বন্ধ না করলে, যতই শৌচালয় তৈরি করা হোক, মেয়েদের ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধ হবে না।