পুলিশকর্তার মুখমণ্ডল বড়ই করুণ দেখাচ্ছিল! বস্তারের ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ি পথে কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’য় মাওবাদীদের প্রাণঘাতী হামলায় ছত্তীসগঢ় কংগ্রেসের প্রথম সারির প্রায় সব নেতা নিকেশ হয়ে যাওয়ার পরে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক তত্পরতা সে সময়ে তুঙ্গে। দরভা ঘাটিতে সেই হামলার পরে কেটে গিয়েছে দিন দু’য়েক। ছত্তীসগঢ়ের রাজধানী রায়পুরে রাজ্য পুলিশের সদর দফতরে এক কর্তার ঘরে সকাল থেকে চলছে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। ঘন ঘন ফোন বাজছে, মন্ত্রালয় থেকে জানতে চাওয়া হচ্ছে সাম্প্রতিকতম পরিস্থিতি। বসে আছি ওই কর্তার বিশালাকার ঘরের অ্যান্টি-চেম্বারে। বৈঠকের ফাঁকে এক পুলিশকর্তা তাঁর মোবাইলে রাখা ছবি দেখিয়ে বলতে থাকেন, “দেখেছ, কী ধরনের ভয়ঙ্কর সব অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে মাওবাদীরা! রকেট থেকে কালাশনিকভ, সব আছে ওদের! যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধ!” পাশ থেকে আর এক পুলিশকর্তার ঘোষণা: “এই যুদ্ধে আমাদের জিততেই হবে।”
কীসের যুদ্ধ? কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ? ‘আমরা’ কারা? জেতা কাকে বলে?
সেই বস্তারেই সাম্প্রতিক মাওবাদী হামলায় সিআরপিএফ ও রাজ্য পুলিশের কর্মী-সহ ষোলো জনের মৃত্যুর পরে প্রশ্নগুলো ফের মনে এল। এই ঘটনার পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে ছত্তীসগঢ়ে আসেন। জগদলপুরে গিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিন্দে যা বলেছেন, তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি বলতেই পারেন। তিনি বলেছেন, কড়া হাতে মাওবাদীদের এই হিংসা দমন করতে হবে। কোনও সন্দেহ নেই, এই ধরনের লাগাতার হিংসার পরে কড়া না হলে রাজধর্ম পালন করা যায় না। তা কাম্যও নয়। কিন্তু এরই পাশাপাশি আরও একটি কথা বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলেছেন, মাওবাদীদের এই হামলার বদলা নেওয়া হবে।
কড়া হওয়ার অর্থ বোঝা যায়, কিন্তু বদলা নেওয়ার অর্থ কী? প্রশাসনিক কঠোরতা নিশ্চয়ই জরুরি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ও কল্যাণকামী এক রাষ্ট্র কী ভাবে ‘বদলা’ নিতে চায়? বদলা নেওয়া আর ‘সমাজের মূলস্রোতে’ ফেরার আহ্বান জানানো একই সঙ্গে কী ভাবে সম্ভব?
একা শিন্দেকেই বা দোষ দিই কী করে? তিনি তো এই তালিকায় আপাতত সর্বশেষ সংযোজন। তাঁর আর এক পূর্বসূরি পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমও তো একই ভঙ্গিমায় বদলার কথাই বলেছিলেন। ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে চালু করেছিলেন ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’। এই অভিযানে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে শামিল হয়ে যৌথ অভিযান চালায় সাতটি রাজ্য: অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গ। মাওবাদীদের সন্ধানে প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে গ্রামে আধা সামরিক বাহিনী পাঠানোর আগে সেই চিদম্বরম কি এক বারও ভেবেছিলেন, কেন ভূমিপুত্রেরা আর রাষ্ট্রশক্তির কাছে সুবিচার চাইতে যান না? পাশাপাশি, ছত্তীসগঢ়ে ‘সালওয়া জুড়ুম’ অভিযানের অনুষঙ্গ হিসেবে বার বার উঠে এসেছে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে আদিবাসীদের উত্খাত, বাড়ি বাড়ি আগুন জ্বালানো, ধর্ষণের পরে খুন একের পর এক অভিযোগ। মাওবাদী দমন অভিযানে তত দিনে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন প্রয়াত কংগ্রেস নেতা মহেন্দ্র কর্মা।
মাওবাদীদের কড়া বার্তা দিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই অভিযান শুরু করেছিল অতি-বামপন্থী সংগঠনটির দুর্গ বলে পরিচিত ছত্তীসগঢ়ের দন্তেওয়াড়া জেলা থেকেই। পরিণতি হয় মারাত্মক। সিপিআই (মাওবাদী)-র সামরিক শাখা পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ) এর বদলায় ২০১০-এর ৬ এপ্রিল হামলা চালায় দন্তেওয়াড়ার কাছে। নিহত হন সিআরপিএফের ৭৬ জন জওয়ান। ওই হামলার পরে মাওবাদীরা যা জানায়, তার মোদ্দা কথা: ওই হামলা ক্ষোভ, যন্ত্রণা, অপমান, শোষণ এবং নিপীড়নের বদলা।
না, চিদম্বরমও একা নন। তারও আগে? সেই খলিস্তানি আন্দোলনের সময়ে রাজীব গাঁধী যেমন বলতেন, আমাদের এত জনকে খলিস্তানি জঙ্গিরা মেরেছে, ওদেরও এত জনকে খতম করা গিয়েছে। তখন অবশ্য ইন্দিরা গাঁধীর জমানা। এর পরে, অকালিদের শায়েস্তা ও ভিন্দ্রানওয়ালেকে খতম করার জন্য ১৯৮৪-র ৩ জুন স্বর্ণমন্দিরে শুরু হয়েছিল সামরিক অভিযান ‘অপারেশন ব্লু স্টার’। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বটে! কিন্তু, তার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির যে আস্ফালন ছিল, তার পরিণাম অজানা নয়।
ইতিহাস বলছে, এই রাষ্ট্রশক্তি কঠোর হাতে আইনের শাসন কায়েম করার পাশাপাশি বদলা নেওয়ার কথাও বলে এসেছে! বদলার পরম্পরা চলেছে ভূমিপুত্রদেরই বিরুদ্ধে! এক ভয়ঙ্কর পন্থা নেওয়ার কথাই বারংবার বলে এসেছেন আমাদের নেতৃবৃন্দ!
প্রতিহিংসাপরায়ণ মুখের সারি তো অনেকই দেখা যায়! কিন্তু এই চিরচেনা রাষ্ট্রশক্তির বাইরেও থেকে যায় আরও কিছু! একটু যত্ন নিয়ে তাকালে দেখা যায় আড়ালে থাকা আরও কিছু মুখের সারি। মানবিক মুখ! দু’একটি উদাহরণ। ঘটনাস্থল ছত্তীসগঢ়, কিন্তু এমন মুখের সন্ধান দেশের প্রায় সর্বত্রই মেলে।
যেমন, বস্তারের এক সময়ের ডিভিশনাল কমিশনার কে শ্রীনিবাসুলু। আগে বস্তারের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা মানুষজন শাকসব্জি নিয়ে শহরের হাটে এলে নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের নাম-ঠিকানা, বাবার নামও লিখে রাখতেন। পরে কোথাও কোনও ঘটনা ঘটলেই ওই গ্রামবাসীদের নামে এফআইআর দায়ের করত পুলিশ। আদিবাসীরা এই প্রথায় আপত্তি করলেও তাঁদের সেই আপত্তি কানে তোলা হয়নি বলে বার বার অভিযোগ উঠেছে। এর বিরুদ্ধে আদিবাসীরা এক বার নারায়ণপুর জেলায় প্রতিবাদ মিছিল করেন। পুলিশ সেই মিছিল আটকাতে চাইলে শ্রীনিবাসুলু বলেন, ওরা তো আমাদেরই লোক! আমাদের লোকেরা আমাদের কাছে এলে আটকানোর কী আছে? বরং ওঁদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করুন। মূলত তাঁর প্রচেষ্টায় শহরে নানা কাজে আসা আদিবাসীদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখার প্রথা বন্ধ হয়। রাষ্ট্রশক্তি সম্পর্কে ভিন্ন এক ধারণা নিয়ে সে দিন বস্তারের আদিবাসীরা গ্রামে ফিরেছিলেন।
আর এক জন, বিজাপুরের প্রাক্তন জেলাশাসক আর প্রসন্ন। কোনও দেহরক্ষী ছাড়াই মোটরবাইকে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরতেন তিনি। তেলুগু ভাষা জানতেন তিনি। অন্ধ্রপ্রদেশ লাগোয়া বিজাপুরের গ্রামের মানুষ তাঁর কাছে মনের কথা খুলে বলত। ২০১০-এর শেষ দিকে তিনি সরগুজার জেলাশাসক হিসেবে বদলি হয়ে যান। তাঁকে যেতে দেওয়া হবে না বলে বিজাপুরের রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন আদিবাসীরা। বস্তার ও বিজাপুরে মাওবাদী হামলার ঘটনাও সে সময়ে অনেক কমে এসেছিল।
কিংবা, দন্তেওয়াড়ার প্রাক্তন জেলাশাসক ওমপ্রকাশ চৌধুরী। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে আবাসিক ব্যবস্থায় একেবারে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর স্তর পর্যন্ত পড়াশোনা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার হরেক ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। স্কুল-কলেজ, হস্টেল, প্রেক্ষাগৃহ তৈরি করে দন্তেওয়াড়ার চেহারাটাই বদলে দিয়েছেন তিনি।
অভিযান চলুক। কিন্তু উগ্রপন্থা দমনের জন্য। বদলা নেওয়ার জন্য নয়। পাশাপাশি তৈরি হোক রাষ্ট্রের এ রকম সহৃদয় মডেল! মানবিক মুখ! যে সহজ ভাবেই বলে, ‘ওরা’ তো আমাদেরই লোক! ওদের আসতে দিন!