য ত বদলায়, তত একই থাকে। প্রবচনটি পুরানো। এবং আজও সমান সত্য। অর্ধ শতাব্দী আগে দেশে ‘চিন নিপাত যাক’ রব উঠিয়াছিল, কলিকাতা শহরের রাস্তাতেও চিনা মানুষরা বিপন্ন হইয়াছিলেন। আজ নূতন করিয়া চিনের বিরুদ্ধে জনমত জাগিয়াছে। তফাত অনেক। সে দিন সোশাল মিডিয়া ছিল না, আজ সোশাল মিডিয়াই সর্বগ্রাসী, সুতরাং ‘চিনা পণ্য বয়কট করুন’ আহ্বান ফেসবুকাদি মাধ্যমেই প্রচারিত, পুনরাবৃত্ত ও লাইক-প্রাপ্ত হইতেছে। সে দিন যুদ্ধ লাগিয়াছিল সরাসরি চিনের সহিত, আজ যুদ্ধ নাই, অন্তত এখনও নাই, এবং যুদ্ধপরিস্থিতিও চিনের সহিত নহে, কিন্তু প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে চিন বন্ধু মানিয়াছে, সুতরাং তাহার বিরুদ্ধে আসমুদ্রহিমাচল জেহাদ ঘোষণার এই ব্যগ্রতা। কিন্তু এই সকল তফাত বাহিরের পরিস্থিতির। অন্তরে কোনও পরিবর্তন নাই। রাষ্ট্রীয় বিরোধকে দেশে দেশে বৈরিতায় পর্যবসিত করা এবং তাহার পরে এক দেশের মানুষকে অন্য দেশের মানুষের শত্রু বলিয়া মনে করা— শতাব্দী বদলাইয়া যায়, মনোবৃত্তি একই থাকে।
চিন কেন ভারতের সুরে সুর মিলাইয়া পাকিস্তানকে সন্ত্রাসের পোষক বলিয়া ঘোষণা করে নাই, বরং তাহাকে চিরবন্ধু বলিয়া কাছে রাখিয়াছে? এমন দেশের পণ্য ভারতীয়রা পয়সা খরচ করিয়া কেন কিনিবে? ইহাই আপাতত দেশভক্তদের প্রশ্ন। কিনিবে, কারণ চিনা পণ্য দামে সস্তা। দামে সস্তা বলিয়াই সেই পণ্য কেবল ভারতের নহে, বিশ্বের বাজার দখল করিয়াছে। সস্তা বলিয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও তাহার আমদানি রোধ করিবার জন্য মুক্ত বাণিজ্যের পায়ে বেড়ি পরাইয়া চড়া শুল্ক বসাইতে হইয়াছে, তবু তাহার আগ্রাসন রোধ করা যায় নাই। ভারতের বাজারে রকমারি চিনা পণ্যের আগ্রাসন নূতন নহে, ইহার আগেও বিভিন্ন শিল্পনির্মাতা চিনা প্রতিযোগীর দাপটে নিজেদের ব্যবসার ক্ষতি হইতেছে বলিয়া শোরগোল তুলিয়াছেন, লাভ হয় নাই, বাজারের নিয়মেই চিনা পণ্য বাজার দখল করিয়াছে এবং দখলে রাখিয়াছে। আজ শোরগোলের কারণ জাতীয়তাবাদ। স্বদেশি শিল্পকে বাঁচাইবার পবিত্র স্লোগান বাজারকে স্বধর্ম হইতে টলাইতে পারে নাই, পবিত্রতর দেশপ্রেমও পারিবে বলিয়া প্রত্যয় হয় না।
এই সত্যটি চিন জানে। সে বুঝিয়া লইয়াছে, সবার উপরে বাজার সত্য। এবং বিশ্বায়নের দুনিয়ায় সেই বাজারে কোনও দেশ, জাতি, রাষ্ট্রের বিচার নাই, দেশভক্তি বা জাতীয়তাবাদ তাহার নিকট তুচ্ছ হইয়া যায়। যাঁহারা সোশাল মিডিয়ায় ‘শত্রু’ চিনের মুণ্ডপাত করিয়া চিৎকার করেন, তাঁহারাও বাজারে খেলনা অথবা তালাচাবি কিংবা আতসবাজি বা মোমবাতি কিনিবার সময় চিনা পণ্য কিনিয়া ঘরে ফেরেন, কারণ খরচ কম পড়ে। পুরানো মতে স্বদেশি আন্দোলনের দিন গিয়াছে। স্বদেশি পণ্য এখনও চলিতে পারে, তবে সস্তা হইলে তবেই। সুতরাং, নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার জাতীয়তাবাদী সহকর্মীদের ভারতেও, বাজারের নিয়ম অলঙ্ঘ্য বলিয়াই মানিতে হইবে। যাঁহারা চিনের পণ্য বয়কট করিবার ডাক দিতেছেন, তাঁহারা অসার চিৎকার ছাড়িয়া বরং নিজ নিজ কাজে মন দিন, কম খরচে ভাল পণ্য নির্মাণের চেষ্টা করুন, বাজারের আশীর্বাদ মিলিবে। বস্তুত, যেখানে চিনা পণ্যের কাটতি মার খাইয়াছে, সেখানে স্বদেশিয়ানার কারণে তাহা মার খায় নাই, পণ্যের গুণমান যথেষ্ট ভাল নয় বলিয়াই ক্রেতারা মুখ ফিরাইয়াছেন। ইহাই বাজারের নিয়ম। চিনকে যদি হারাইতে হয়, রণক্ষেত্র একটিই। বাজার।