হাহা, মজা আসছে। খুব নাকি হইহই পড়ে গেছে, যেই বলেছি, আমার নামটা গোটা উত্তর কোরিয়ায় কেউ নিতে পারবে না। লোকে বোধহয় ভাবছে, ননসেন্স নাটক। আরে, কারও যদি ভগবানের মতো ক্ষমতা হাতে এসে পড়ে, মানে চূড়ান্ত ক্ষমতা, অ্যাক্কেরে ক্ষমতাতম ক্ষমতা, যাকে বলে যাচ্ছেতাই করার নিরঙ্কুশ অধিকার, তার আস্তে আস্তে তামাশার দিকে মন চলে যাবেই। কারণ একটা এমনি মানুষ যা যা ফ্যান্টাসি বোনে, সে তো আমার কাছে পানসে বাস্তব। সুন্দরী মেয়ে চাই, সক্কলের বিনা আপত্তিতে এক সেকেন্ডে তুলে আনতে পারি। কোটি কোটি টাকা দামের গাড়ি চাই, কথা খসাতে না খসাতে চড়ে বসতে পারি। গোটা দ্বীপে একলা নাচব, তক্ষুনি তথাস্তু। আমার বাপ-ঠাকুদ্দাও এ ভাবেই জীবন কাটিয়ে গেছে। আমরা এই দেশটার ভগবান। সে টার্গেটেই মূর্তি গড়া হয়, স্লোগান তৈরি হয়, মিডিয়ায় টানা পুজোপাঠ চলে। ছোটরা তো ভাবে আমি পেচ্ছাপ-পায়খানাও করি না। আমিও একের পর এক উপাধি নিই, নিজের ক্ষমতা বাড়িয়ে যাই। এখন এমন জায়গায় ঠেকেছে, আর নতুন কিছু ভেবে পাচ্ছি না। কচলে কচলে তেতো হয়ে গেছে। তাই মুখ বদলাতে একটু উদ্ভুট্টি বাগাচ্ছি। আর সত্যিই তো, আমার নাম কখনও অন্যের হতে পারে? এই যে সাংঘাতিক মানুষটা, যে গ্লোবটাকে মুঠোয় নিয়ে যখন-তখন চিপে দেয় ও ফের ছাড়ে, সে তো একপিস-ই। এমনিতেই লোকের উচিত সব বড় বড় লোকের নাম সিল করে দেওয়া। কলকাতায় যখন রবীন্দ্রনাথ রোল সেন্টার হয়, তখন কি মহাপুরুষের দাড়িতে সস লেগে যায় না? তা গণতন্ত্রে তো অমন ফাজলামি চিরকালই চলবে, গণতন্ত্র মানেই অসংখ্য গবেটকে তুইয়ে চলার নির্বোধ বন্দোবস্ত। সে যাকগে, আমি রুল করলাম, আমার নাম আর কারও হবে না। যাদের ওই নামটা বহুদ্দিন ধরে আছে? তেত্তিরিশ বা সাতাত্তর বছর ধরে যে নিজেকে ওই নামে চিনে আসছে? কর্তৃপক্ষ তাদের ‘শিক্ষিত’ করে তুলবে, স্বেচ্ছায় ওই নামটা ছেড়ে দিতে। যদি ভুল করে তার ভাই-ভাতিজা পুরনো নামটায় ডেকে ফেলে? তা হলে আর কী? খানসতেরো মৃত্যুদণ্ড দিয়ে দেব’খন। খোলা চত্বরে ব্যাটাদের মারা হবে। এন্টারটেনমেন্ট কে এন্টারটেনমেন্ট, লোকে ওয়ার্নিংও পেল।
মৃত্যুদণ্ড দিতে হেভি লাগে, কিন্তু সে চার্মটাও আস্তে আস্তে কমছে। বিশেষ করে সিংহাসনে বসার পর পরই আমার কাকাটাকে খুন করে অ্যায়সা মজা মেরেছিলাম, ওর আর রিপিট পাব না। অবশ্য তা বলে থেমে থাকলে চলে না, প্র্যাকটিসটা লাগিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু ওইটায় সব্বাই একেবারে শকের চোটে মুচ্ছো। কাকা ছিল দেশের বিরাট হত্তাকত্তা। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। সবাই ভেবেছিল, ওর পরামর্শেই দেশ চলবে। আরও ক’টা পাবলিক ছিল, বিরাট বিরাট হনু, সব আমার বাবার প্রিয় সভাসদ। বুঝতেও পারেনি, আমি তাদের ডেলি পেন্নাম ঠুকে রাজধর্ম শেখা তো দূর, গোড়াতেই টি-টোয়েন্টি শুরু করব। সবক’টাকে হয় এমন নিম্ন পোজিশনে নামিয়ে দিয়েছি, হাহাকারিয়ে লাট খাচ্ছে। কিংবা মেশিনগানে ঝাঁঝরা। আর আমাদের একটা পবিত্র ট্র্যাডিশন আছে, কাউকে যখন শাস্তি দিই, তার বংশের কেন্নোকেও ছাড়ি না। জিন বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। ক্রিমিনালের বাচ্চাকাচ্চা, ভাইপো, ভাড়াটে, রক্ষিতা, রক্ষিতার চাকর, সক্কলেই তো ক্রিমিনাল, তাই না? তা ছাড়া রিভেঞ্জের কণামাত্র ব্যাকটেরিয়া অ্যালাও করতে নেই। একফোঁটা ছেলে বলে ইগনোর দিলি, কিংবা জল্লাদের মায়া হল বলে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে এল, ব্যস, সে ব্যাটা অ্যাডাল্ট হয়ে ক্যাচাল পাকাবেই। কাকার সব আত্মীয়কে শেষ করেছি। যে যেখানে ছিল, লতায় পাতায়। আর যে-ই রিস্ক নিতে পারুক, স্বৈরাচারী কখনও পারে না। তাকে সব কাজ ডবল-সুষ্ঠু ভাবে সারতে হয়। দেশবাসীও তা দেখে শেখে। এই তো, আমি একটা ভোট করেছিলাম। যদিও আমি একাই ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম, তবু যদি কেউ মনে করে আমাকে অপছন্দ, তা হলে ‘না’ ভোট দিতে পারে। দেখা গেল, দেশের সক্কলে ‘হ্যঁা’ ভোট দিয়েছে। ঠিকই করেছে। সূর্য ওঠা উচিত কি না, এই প্রশ্নে কোন গাধা ‘না’ বলবে? আমার নামে ওটাই তো পাহাড়ের গায়ে খোদাই করেছি, আধ কিলোমিটার জুড়ে লেখা: জগমগাতা সূর্য অমর রহে।
মরে গেলেও ছাড়ব না অবশ্য। আমার বাবা যখন মারা গেল, রাশি রাশি পুলিশ মিলিটারি গোয়েন্দা ছড়িয়ে পড়েছিল শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে, দেখার জন্যে, সবাই ঠিকঠাক কাঁদছে কি না। যে রাস্কেল একটুও কম ফোঁপাচ্ছে, বা হাউহাউটা তীব্রতায় ও ডেসিবেলে শর্ট, ব্যস, সটান লেবার ক্যাম্প। অন্য ডিক্টেটররা গাধা, মানুষের মাথা নিচু করে হুকুম তামিলটা দেখেছে, তার কলজের ভেতর তুরপুন সেঁধিয়ে ইমোশনটাকে আচ্ছাসে রগড়ানি দেয়নি। আমরা এই ফিল্ডে চাম্পি। আনন্দ বা শোক অবধি নিংড়ে কন্ট্রোল করব। এ বার ভাবছি, আমার জন্মদিনে রাষ্ট্রীয় উত্সব করব, অনুশাসন: দু’পাটি হৃদয় বের করে হাসতে হবে, গাল থেকে লাল খুশিজেল্লা। আবার আমার নিতম্বে যদি মশা কামড়ায়, সারা দেশকে নিতম্বে হাত বুলিয়ে ফোঁসফোঁস চালাতে হবে, পেট্রিয়টিক প্রাণায়াম।
ভাই রে, মানুষকে শুধু চাবুক মারলে চলে না, তাদের অন্তরে কুরে কুরে লিখতে হয়, তারা বস-এর পদতলে ময়লাফুটকি। তাদের গোদা পেটের ভেতর থেকে আনুগত্যের নাদটা তুলতে হয়, ‘দাসত্বে ধন্য’ বিশ্বাস করাতে হয়। তাই নামও আমি ঠিক করে দিই, চুলের ছাঁটও। গরমের দিনে কতটা ঘাম, ভোররাত্রে কতটা কাম, সে ভি। লোকে হেঁচকি তুলতে থেমে যাবে, প্রসব-কাতরানির কালেও চমকে: স্যরের পছন্দ হবে তো? তোমরা আজ যা ভাবছ ভাঁড়ামির ভেন্ডি, কাল স্যালুটিয়ে বুঝবে, উহা সুপ্রিম কর্তা-ব্রেনের মোডাস অপারেন্ডি!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়