প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষায় নরেন্দ্র মোদীর অশ্বমেধের ঘোড়া এখনও অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু, তাঁর সমর্থকদের মতোই, তাঁর বিরোধীরাও অদম্য। সমর্থকদের কথায় প্রশস্তিবাচক বিশেষণের ছড়াছড়ি— প্রশাসক হিসেবে তিনি দক্ষ, দৃঢ়, যে কোনও দুর্নীতির অতীত, তাঁর নিজস্ব অর্থনৈতিক প্রশাসনের ভঙ্গিমায় (যার নাম হয়েছে ‘মোদীনমিকস’) তিনি গুজরাতের কপালে সমৃদ্ধির সোনার কাঠি ছুঁইয়েছেন এবং সর্বভারতীয় মঞ্চে সেই ম্যাজিকের পুনরাবৃত্তির সময় এসেছে। মোদীর বিরোধীরাও সমান সরব। ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসার প্রসঙ্গটি যদি বাদও রাখি, অরবিন্দ কেজরীবালের ভাষায় মোদীর গুজরাত মডেলটি কিছু বিশেষ শিল্পগোষ্ঠীর জন্যে অবারিত দ্বার পাইয়ে দেবার নীতি বই আর কিছু নয়। গুজরাতের যে আর্থিক বৃদ্ধির হার নরেন্দ্র মোদীর প্রচারের প্রাণকেন্দ্র, সমালোচকরা বারে বারেই বলছেন, সেই বৃদ্ধির ফল অসম ভাবে বণ্টিত হয়েছে, দারিদ্র তেমন কমেনি এবং মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে গুজরাত তার আর্থিক উচ্চতার ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারেনি।
মোদীর ‘গুজরাত মডেল’কে কে কী চোখে দেখবেন, সেটা অংশত নির্ভর করে দর্শকের নিজস্ব রাজনৈতিক ও আদর্শগত অবস্থানের ওপর। আবার, অর্থনীতির কোন সূচককে কে কতটা গুরুত্ব দেবেন, আর্থিক বৃদ্ধির হারকে বেশি জরুরি মনে করবেন নাকি দারিদ্র দূরীকরণকে, তার ওপরও নির্ভর করছে মোদীর মডেলের গ্রহণযোগ্যতা। কিন্তু, মতাদর্শগত অবস্থানের কথা যদি বাদও রাখি, পরিসংখ্যান কী বলছে? মোদীর শাসনকালে গুজরাতের অর্থনীতি ঠিক কতখানি এগিয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে প্রথমে দেশের মোট ১৬টি বড় রাজ্যের দিকে তাকাতে হবে। যে রাজ্যে জনসংখ্যা যত বেশি, সেখানে বিভিন্ন আর্থিক সূচকের মাথাপিছু গড় বাড়ানোর কাজও তত কঠিন। নাগাল্যান্ডের সঙ্গে উত্তর প্রদেশের তুলনা করলে উত্তর প্রদেশের প্রতি অন্যায়ই হবে। কাজেই, সমানে-সমানে তুলনা করা ভাল। তবে, বড় রাজ্যগুলির মধ্যেও যেখানে জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি, সেখানে সূচকের উন্নতি ঘটানো অপেক্ষাকৃত কঠিন।
অর্থনৈতিক উন্নতির সবচেয়ে পরিচিত সূচকটি দিয়েই শুরু করা যাক— মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির হার। নরেন্দ্র মোদীর সমর্থকরা বারে বারেই জানিয়েছেন, এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাঁর আমলে গুজরাতে আর্থিক বৃদ্ধির হার অবশিষ্ট ভারতের চেয়ে দ্রুততর, এবং এই বৃদ্ধির হারই মোদীর অর্থনৈতিক মডেলের শক্তির সবচেয়ে বড় প্রমাণ, এমন দাবি করার লোকের বিন্দুমাত্র অভাব নেই।
এই দাবিতে দুটো বড় গলতি আছে। প্রথমত, শুধু গুজরাতই নয়, এই একই সময়ে মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানাতেও আর্থিক বৃদ্ধির হার অবশিষ্ট ভারতের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু, মহারাষ্ট্র মডেল বা হরিয়ানা মডেল নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। দ্বিতীয় কথা, শুধু মোদীর আমলেই নয়, ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকেও গুজরাতে আর্থিক বৃদ্ধির হার অবশিষ্ট ভারতের তুলনায় বেশি ছিল। কাজেই, মোদী গুজরাতের অর্থনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন, এমন দাবি করতে হলে আরও গভীরে যেতে হবে। দেখতে হবে, অবশিষ্ট ভারতের সঙ্গে গুজরাতের বৃদ্ধির হারের ফারাক তাঁর আমলে বেড়েছে কি না। অন্য কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রেও এই ফারাক বেড়েছে কি না, দেখতে হবে। যদি দেখা যায়, মোদীর আমলে গুজরাতের সঙ্গে অবশিষ্ট ভারতের বৃদ্ধির হারের ফারাক বেড়েছে, এবং একই সময়কালে অন্য কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে তেমন ঘটনা ঘটেনি, একমাত্র তখনই বলা যাবে যে মোদীর মডেল সত্যিই কার্যকর।
১৯৯০-এর দশকে গুজরাতের মাথা পিছু আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৮%, জাতীয় গড় ছিল ৩.৭%। একুশ শতকের প্রথম দশকে এই হারদুটি হয়েছে যথাক্রমে ৬.৯% ও ৫.৫%। অর্থাৎ, ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় তার পরের দশকে, অর্থাৎ গুজরাতে মোদীর শাসনকালে, গুজরাতে গোটা দেশের গড়ের চেয়ে আয়বৃদ্ধি হয়েছিল সামান্য বেশি হারে— ১.১% বেশির পরিবর্তে ১.৩% বেশি। একে কি উন্নতি বলা চলে? অবশ্যই। এই ‘উন্নতি’ কি ‘মোদীনমিকস’ নিয়ে প্রচার ও উচ্ছ্বাসের বাড়াবাড়ির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ? একেবারেই নয়। মহারাষ্ট্রের কথা ধরা যাক। ২০০০-এর দশকে আয়বৃদ্ধির অঙ্কে দেশে প্রথম স্থানে আছে রাজ্যটি। ১৯৯০-এর দশকে এই রাজ্যের আয়বৃদ্ধির হার ছিল ৪.৫%, এবং পরের দশকে তা হয়েছে ৬.৭%। জাতীয় গড়ের চেয়ে মহারাষ্ট্রের আয়বৃদ্ধির হারের ফারাক ০.৮% থেকে বেড়ে হয়েছে ১.১%।
মাথাপিছু আয়ের অঙ্কে যে তিনটি রাজ্য গত ত্রিশ বছর ধরে দেশের প্রথম তিনটে স্থান দখল করে রেখেছে, সেগুলো হল হরিয়ানা, পঞ্জাব ও মহারাষ্ট্র। এই সময়কাল জুড়ে গুজরাত গড়ে চতুর্থ স্থানে থেকেছে। ১৯৮০-র দশক থেকে আজ পর্যন্ত ক্রমতালিকায় যে রাজ্যগুলি ক্রমে উন্নতি করেছে, সেগুলি এই রকম— মহারাষ্ট্র তৃতীয় থেকে প্রথম স্থানে এসেছে, গুজরাত চতুর্থ থেকে তৃতীয়, কেরল দশম থেকে পঞ্চম এবং তামিলনাড়ু সপ্তম থেকে চতুর্থ। এই রাজ্যগুলি যখন ক্রমে উন্নতি করছিল, তখন একটি রাজ্য সমানে পিছিয়ে পড়েছে। পঞ্জাব। ১৯৮০ এবং ১৯৯০-র দশকের অত্যন্ত ভাল অবস্থান থেকে ২০১০ সালে পঞ্জাব নেমে এসেছে সপ্তম স্থানে। কাজেই, ভুলে গেলে চলবে না যে কোনও ক্রমতালিকার মতো এখানেও কোনও এক বিশেষ রাজ্যের ক্রমসংখ্যার উন্নতির দুটো কারণ থাকতে পারে— হয় সে রাজ্য নিজে ভাল করেছে, অথবা অন্য কোনও রাজ্য বেশ খারাপ করেছে।
গুজরাত যে দীর্ঘ সময় ধরে মাথাপিছু আয় এবং আয়বৃদ্ধির হার, উভয় অঙ্কেই দেশের সেরা রাজ্যগুলির মধ্যে থাকতে পেরেছে, তার জন্য কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য। কিন্তু সেই কৃতিত্ব মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার সঙ্গে ভাগ করে নিতে হবে, কারণ এই রাজ্যদুটিও একই কাজে সফল। অন্য দিকে, মোদীর শাসনকালে গুজরাতের আয়বৃদ্ধির হার তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে, এমন কথা বলার উপায় নেই।
এ বার, এই সব এগিয়ে থাকা রাজ্যের পাশাপাশি বিহারের কথা ভাবুন। রাজ্যটি চিরকাল মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির হারের তালিকায় একেবারে শেষে থেকেছে। ১৯৯০-এর দশকে বিহারে আয়বৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের তুলনায় ২.৭% কম ছিল। ২০০০-এর দশকে তা জাতীয় গড়ের চেয়ে ১.৩% বেশি। কাজেই, আয়বৃদ্ধির অঙ্কে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য কৃতিত্ব যদি কোনও রাজ্যের প্রাপ্য হয়, তবে সেটা নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত নয়, নীতীশ কুমারের বিহার।
কেউ দাবি করতেই পারেন, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা বা গুজরাতের মতো এগিয়ে থাকা রাজ্যে আর্থিক বিকাশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা বা সামান্য উন্নতি করার কাজটি বিহারের মতো সম্পূর্ণ পশ্চাদপদ রাজ্যকে ঘুরে দাঁড় করানোর তুলনায় অনেক কঠিন। হাজার হোক, যে পিছিয়ে আছে তার আরও উন্নতি করার পরিসর বেশি। কিন্তু, একই সঙ্গে অন্য কেউ বলতে পারেন, পিছিয়ে থাকা রাজ্যে উন্নতিসাধনের কাজ বেশি কঠিন, কারণ কাজটা যদি সহজই হত, এত দিনে কেউ না কেউ সেটা করে ফেলতেন। বিহারের সঙ্গে তুলনার ক্ষেত্রে আরও একটা কথা মনে রাখা ভাল— জনসংখ্যার নিরিখে বিহার দেশে তৃতীয় বৃহত্তম রাজ্য। গুজরাত দশম। লেখার গোড়াতেই বলেছি, ছোট রাজ্যের তুলনায় বড় রাজ্যে উন্নতিসাধনের কাজটি কঠিনতর। কাজেই, গুজরাতের তুলনায় বিহারে নীতীশ কুমার দুষ্করতর কাজ করেছেন, এমন দাবি কেউ করতেই পারেন।
এ বার অন্য অর্থনৈতিক সূচকগুলোর দিকে তাকানো যাক। মানব উন্নয়ন সূচকের নিরিখে গোটা দেশে কেরলের ধারেকাছে আর কোনও রাজ্য নেই। ১৯৮০ বা ১৯৯০-এর দশকে গুজরাতে এই সূচক সর্বভারতীয় গড় সূচকের তুলনায় ভাল ছিল। ২০০০-এর দশকে গুজরাতের দ্রুত অবনতি হয়েছে এবং এই রাজ্যের সূচক কমে জাতীয় গড়ের স্তরে ঠেকেছে। ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত গুজরাতে আর্থিক অসাম্য জাতীয় গড়ের তুলনায় কম ছিল। নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে তা জাতীয় গড়কে টপকে গিয়েছে।
রাজ্যের মোট জনসংখ্যায় দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের অনুপাতের হিসেবে হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব, কেরল, হরিয়ানা, অন্ধ্র প্রদেশ এবং কর্নাটকের মতো গুজরাতও দীর্ঘ দিন ধরেই ভাল অবস্থায় রয়েছে। জাতীয় গড়ের তুলনায় এই রাজ্যগুলিতে দরিদ্র মানুষের অনুপাত অনেক কম। কিন্তু, দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে গত এক দশকে সফলতম দুটি রাজ্য হল তামিলনাড়ু এবং বিহার।
গত তিন দশকে গুজরাতের আয়বৃদ্ধির হার বা মাথাপিছু আয়ের রেকর্ড ভাল, সেটা অস্বীকার করার প্রশ্ন নেই। কিন্তু, মোদীর অর্থনৈতিক মডেলের ‘অত্যাশ্চর্য সাফল্য’ নিয়ে যে প্রচার চলছে, পরিসংখ্যানের বিচারে তা নিতান্ত ভিত্তিহীন। গুজরাত আর্থিক ভাবে অগ্রসর একটি রাজ্য, যার থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, কিন্তু গত দশ বছরে সেখানে নতুন করে এমন কোনও উন্নতি হয়নি, যাতে এই মোদী-উন্মাদনার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। দেশের বর্তমান শাসকদের নিয়ে তিতিবিরক্ত হওয়ার এবং পরিবর্তনের জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকার অনেক কারণ আছে। কিন্তু তার থেকে যাঁরা প্রাণপণে আশা করছেন যে মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেই ভারতীয় অর্থনীতি তাঁর জাদুস্পর্শে ঘুরে দাঁড়াবে, তাঁরা শেয়ার বাজারের কথা মাথায় রাখতে পারেন। সেই বাজারে চড়া প্রত্যাশার আবহাওয়ায় বুদ্বুদের জন্ম হয়। সেই বুদ্বুদ বাড়তে থাকে। প্রত্যাশার সঙ্গে পরিসংখ্যানের মিল না থাকলে কখনও না কখনও সে বুদ্বুদ ফাটতে বাধ্য। সেটা কিন্তু বড্ড যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা।
মৈত্রীশ ঘটক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস-এ অর্থনীতির অধ্যাপক। সঞ্চারী রায় ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারিক-এ অর্থনীতির গবেষক।