সমসাময়িক এক তরুণ কবি প্রশ্ন তুলিয়াছেন, যাহা হইয়াছে, ‘দূর দেশে, পাশের বাড়িতে’ বলিয়াই কি নিজেরা এখনও ‘অক্ষত’ বোধ করা সম্ভব? ঢাকায় মার্কিনপ্রবাসী বাংলাদেশি লেখক অভিজিত্ রায়ের মর্মান্তিক হত্যাসংবাদের পর অক্ষত বোধ করা সত্যই কঠিন। রাজধানীর কেন্দ্রভূমিতে, সংস্কৃতির পীঠস্থল বইমেলা প্রাঙ্গণের অনতিদূরে, ভাষাবেগসিঞ্চিত ফেব্রুয়ারি মাসে ঘাতকদল যে অনায়াস অব্যর্থতায় চিন্তাশীল তরুণের গলাটি কাটিয়া ফেলিল, তাহাতে ধর্ম-ভাষা-জাতি-দেশ নির্বিচারে মুক্ত বুদ্ধিবৃত্তির মানুষ আক্রান্ত বোধ করিতে বাধ্য। এই আক্রমণ ঘৃণ্য, অপরাধীদের কঠোরতম শাস্তি প্রাপ্য, প্রশাসনের কঠিন পদক্ষেপ বাঞ্ছনীয়, ইত্যাদি সমস্ত কথা ছাপাইয়া উঠিবে একটি বার্তা: চিন্তার স্বাধীনতার উপর, মতের ভিন্নতার উপর এই নৃশংস হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদই যথেষ্ট নয়, চাই প্রতিরোধ। প্রতিবাদ একটি সাময়িক পরিস্থিতি। তাহা যাওয়া-আসা করে, থাকে না। প্রতিবাদ সংগঠিত করা হয়, তাহা ঘনাইয়া উঠে না। প্রতিবাদ যখন স্থায়ী প্রবাহে রূপান্তরিত হয়, তখনই বোধহয় তাহাকে প্রতিরোধ বলে। দূরগত হিংসা-তাণ্ডবে প্রতিবাদ করা চলে। হিংসার কোপ ‘পাশের বাড়ি’টিতে আছড়াইয়া পড়িলে প্রতিবাদে আর কুলাইয়া উঠা যায় না, সমাজের সমস্ত স্তরে প্রতিরোধ জড়ো করিতে হয়।
এ হেন নৃশংস ঘটনা বাংলাদেশে অভিনব বলা চলে না। এগারো বত্সর আগে প্রাণঘাত হইয়াছিল লেখক হুমায়ুন আজাদ-এর। দুই জনই তাঁহাদের ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্বাসে অটল ছিলেন, এবং আক্ষরিক ভাবে প্রাণ দিয়া সেই ‘বিশ্বাস’-এর দাম চুকাইলেন। এগারো বত্সরে বাংলাদেশ অনেক বদলাইয়াছে। কিন্তু কট্টরপন্থী সন্ত্রাসের ধারালো আঘাত এখনও চকিতে তাণ্ডব ঘটাইয়া যায়, সমাজ বা প্রশাসনের অসহায় দৃষ্টির সম্মুখে। অভিজিত্ রায় বইমেলা হইতে বাহির হইবার পর অতর্কিতে আততায়ীরা তাঁহার উপর যে ভাবে ঝাঁপাইয়া পড়ে, তাহাতে অনেকেই প্রশাসনিক গাফিলতিকে দায়ী করিতেছেন। বাস্তবিক, প্রতিটি ব্যক্তিকে এই ধরনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা কোনও রাষ্ট্র বা প্রশাসনই দিতে পারে না। তাহা দিতে গেলে মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ থাকা যায় না। এই দায় সমাজকেই লইতে হইবে। সমাজকেই স্থির করিতে হইবে, হিংসার উন্মত্ত কারবারিরা প্রশ্রয়যোগ্য না কি প্রতিরোধযোগ্য।
সংকটের শিকড় যত দূর ছড়াইয়াছে, তাহাতে প্রতিরোধের কাজটি চট করিয়া হইবে না। দীর্ঘ পরিশ্রম ও প্রত্যয়ের সহিত বিভিন্ন শ্রেণিকে এই প্রতিরোধ চালাইতে হইবে। হত্যাকাণ্ডের পর দিনই ঢাকা শহরে যে মশালমিছিল দেখা গেল, নিশ্চয় তাহার সমসংখ্যার কিংবা আরও বেশি সংখ্যার মানুষ নিহত লেখককে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়া নিধন-কাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করিয়াছেন। প্রশ্নটি যে আসলে ইসলামপন্থা কিংবা ইসলামবিরোধিতার নয়, প্রশ্নটি যে স্বাধীন চিন্তার, গণতান্ত্রিক অধিকারের, এই অতিশয় গুরুতর কথাটি সমাজে চারাইয়া দিবার কাজটি সহজ হইবে না। কিন্তু ‘একুশে’ শেষ পর্যন্ত ‘অমর’ রহিবে কি না, ফেব্রুয়ারির ভাষা-আন্দোলন (১৯৫২), ফেব্রুয়ারির শাহবাগ (২০১২) বনাম ফেব্রুয়ারির হুমায়ুন আজাদ নিধন (২০০৪) কিংবা অভিজিত্ রায় হত্যাকাণ্ড, কোনটি জিতিবে, এই দুরূহ চ্যালেঞ্জের মোকাবিলার উপরই তাহা নির্ভর করিতেছে।