প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিপক্ষে অনেক কথা বলা চলে। তাঁর পক্ষে একটা কথা বলতেই হয়। কিছু পেতে গেলে যে কিছু দিতে হয়, এ কথাটা বলতে মোদী কসুর করেননি। রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি ছাড়ার যে প্রচার করছেন, স্বাধীন দেশে বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলনের পর তার তুল্য নজির খুব বেশি নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন ঢালাও দু-টাকা কিলো চাল দেওয়ার ছক কষছেন, তখন মোদী বলছেন, দেশের সম্পদ সীমিত, যে কাঠ কুড়িয়ে উনুন জ্বালায়, তার বাড়ি গ্যাসের উনুন আনতে গেলে রেস্তদার গেরস্তদের ছাড়তে হবে ভর্তুকি।
সাড়া অবশ্য তেমন মিলছে না। যদি দেশের দৃশ্যটা ধরেন, তা হলে ভারতে ইন্ডিয়ান অয়েলের সাড়ে সাত কোটি গ্রাহকের মধ্যে ভর্তুকি ছেড়েছেন ৬ লক্ষেরও কম। হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়ামের ৪ কোটি ১০ লক্ষের ৪ লক্ষও ছাড়েননি। ভারত পেট্রোলিয়ামের ৩ কোটি ৯৬ লক্ষ গ্রাহকের মধ্যে সাড়ে তিন লক্ষের কম ভর্তুকি ছেড়েছেন। মানে এক শতাংশও নয়। একটা গড়পড়তা হিসেব বলছে, চলতি আর্থিক বছরে ১৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। এমন চললে গোটা বছরে দেড়শো কোটি টাকাও সাশ্রয় হবে না।
এ রাজ্যের ছবিটা একই রকম। মোট ১ কোটি ৪৪ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ভর্তুকি ছেড়েছেন ৪৮ হাজারের কিছু বেশি। এই হিসেব জুলাই পর্যন্ত। মোদীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে রাস্তায় মাদুর পেতে ডান হাত দিয়ে বাঁ পায়ের বুড়ো আঙুল ধরতে লোকে যতটা উৎসাহী, গ্যাসের ভর্তুকি ছাড়তে কেউ ততটা আগ্রহী নয়।
কেন এই দশা? প্রতি সিলিন্ডারে ২৫০-৩০০ টাকা ছাড়লে বছরে আড়াই হাজার-সাড়ে তিন হাজার টাকা বাড়তি খরচ হবে। তা ছাড়তে এত লোক অরাজি কেন? একটা সহজ সিদ্ধান্ত হল, অধিকাংশ মানুষই ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার। গরিবের জন্য একফোঁটাও দরদ নেই। কথাটা হয়তো পুরোপুরি ভুল নয়। কিন্তু আর একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।
একটা কারণ মনে হয়, ভর্তুকি ছেড়ে দেওয়ার পর কী হবে, তা ততটা স্পষ্ট নয়। আজ যিনি রোজগেরে, অবসরের পর তাঁর টানাটানি দশা হতে পারে। অবস্থার পরিবর্তন হলে কি ফের আবেদন করা যাবে ভর্তুকির জন্য?
সাশ্রয়কে সঞ্চয় বলেও মনে করেন অনেকে। রান্নার গ্যাস প্রায়ই গৃহিণীর নামে থাকে। বিত্তবান পরিবারের গৃহবধূও মনে করতে পারেন, সংসারের যে খরচটুকু তিনি বাঁচাতে পারলেন, সেটুকু সংসারে তাঁর অবদান।
সমস্যা হয়তো আরও গভীরে। চার দিকে একটু ঠাহর করলে দেখা যায়, যে ব্র্যান্ডেড স্নিকার ছাড়া পরে না সেই কলেজছাত্র, যিনি সদ্য ছোট গাড়ি বদলে এসইউভি কিনেছেন সেই ব্যবসায়ী, যিনি ডিজাইনার শাড়ি কেনেন সেই গৃহবধূ, যাঁরা সদ্য সিঙ্গাপুর-হংকঙে হানিমুন করে এলেন সেই দম্পতি— ‘বড়লোক’ বললে সবাই চটে যাবেন। তাঁরা মনে করেন, বাজার যা চড়া, খরচ যা বাড়ছে, তাতে তাঁরা কোনও মতে চালিয়ে নিচ্ছেন। ফ্ল্যাট-গাড়ির ইএমআই, টিউশন ফি, চিকিৎসার খরচ, বছরে দু’বার বেড়িয়ে হাতে আর থাকেটা কী?
এই যে অকিঞ্চনের বোধ, এর খানিকটা হয়তো আছে আমাদের সংস্কৃতিতে, ইতিহাসের বোধে। নধর শিশুকেও যেমন ঠাকুমা ‘আহা বাছা রোগা হয়ে গিয়েছে’ বলে কাজলের টিপ দিয়ে দেন, তেমনই ‘আমার যথেষ্ট আছে, ভর্তুকির টাকা আমার দরকার নেই’ বলায় একটা কুণ্ঠা কাজ করে মধ্যবিত্তের। একে তো বামপন্থার দাপটে ধনীর অর্থ দাঁড়িয়েছে গরিবের যম। তার ওপর দুর্ভিক্ষ, দেশভাগ, উদ্বাস্তু হওয়ার স্মৃতি দারিদ্রকে দূরে যেতে দেয়নি। আজ যিনি সুইমিং পুল-জিম-টেনিসকোর্ট-শোভিত আবাসনে থ্রি-বিএইচকে ফ্ল্যাট বুক করছেন, তাঁর বাবা-মা হয়তো কলোনির দু-কামরার ঘরে সংসার পেতেছিলেন। অনেকের বাবা-মা এখনও গ্রামে আধপাকা বাড়ি আগলাচ্ছেন। ‘ফ্যান দে’ আর্তনাদের একটা রেশ অবচেতনে কাজ করে চলে। ‘আমার টাকা দরকার নেই’ বলা যেন দুর্ভাগ্যকে আহ্বান করা।
অর্থনীতি বলে, ধনী-গরিব আপেক্ষিক ধারণা, তাই ‘তুমি কি ধনী?’ প্রশ্ন করলে পাল্টা-প্রশ্ন মনে আসে, ‘কার চাইতে ধনী?’ আইপিএল-এর মতো টুর্নামেন্টে, ফিল্মি অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে, দুর্গাপুজোয় টাকার যে বিস্ফোরণ দেখা যায়, তাতে তাজ্জব হয়েও কূল মেলে না। তারকারা কেবল আসতে-হাসতে যে টাকা নেন, তা শুনলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের জল লুকোতে হয়। তাই ‘সাবসিডি ছাড়ুন’ বললে মনে হয়, ‘আমি কেন?’ যে প্রশ্নটা মোদীকেও করতে কসুর করছেন না অনেকে। মোদীর মন্ত্রীরা কি ‘গিভ ইট আপ’ করেছেন? তাঁর দলের নেতারা কি ছেড়েছেন? না হলে দেশের আর পাঁচটা মানুষকে ভর্তুকি ছাড়তে বলার কী অধিকার আছে তাঁর? ব্যাঙ্কের কর্মী, স্কুলের শিক্ষক, সরকারি কর্মচারীদের তো মনে হবেই, মন্ত্রী, আমলা, সাংসদ, বিধায়ক, কর্পোরেট কর্তা, সচিন তেন্ডুলকর, অমিতাভ বচ্চনরা কি ছেড়েছেন গ্যাস সিলিন্ডারে ভর্তুকি? না হলে আমিই বা ছাড়ব কেন?
প্রথম ধাক্কায় যুক্তিটা খুব শক্ত মনে হয়। কিন্তু আরও একটা তুলনা টানা চলে। নিজেদের সঙ্গেই। ব্যাঙ্কের কর্মী, স্কুলের শিক্ষক, সরকারি কর্মচারীরা দশ বছর আগে যা রোজগার করতেন, এখন করছেন তা থেকে বেশি। ২০০৫ সালে চাকরিতে ঢুকেই রাজ্যের সরকারি কর্মী (স্টেট সার্ভিস অফিসার) যে বেতন পেতেন, ২০১৫ সালে পাচ্ছেন তার চাইতে ২০০ শতাংশ বেশি। তা থেকে ১০ বছরে ৫০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি (কনজিউমার ইনফ্লেশন) বাদ দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ১৫০ শতাংশ বেড়েছে বেতন। একই ভাবে, মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে সরকারি স্কুল শিক্ষকদের এবং সরকারি ব্যাঙ্কের কর্মীদের বেতন (চাকরি শুরুর দিনে) বেড়েছে ১০০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০ বছরে ঠিক দ্বিগুণ হয়েছে। দেশ-বিদেশ, সরকারি-বেসরকারি, যে কোনও নিরিখে এটা ভাল বৃদ্ধি। আরও আছে উৎসাহ-ভাতা, দুর্গম জায়গায় বদলির ভাতা, সহজ ঋণ, স্বাস্থ্যবিমার সুবিধে।
কার জন্য ভর্তুকি
তা বলে এঁদের কি ধনী বলা চলে?
আসলে কী উদ্দেশ্যের নিরিখে বলা হচ্ছে, তার উপরও ‘ধনী’ ‘গরিব’ কথাগুলো নির্ভর করে। বিধাননগরের এক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা সবার জন্য ২ টাকার আউটডোর টিকিট চালু করেছিলেন। আপত্তি তুলতে বলেছিলেন, ‘যে হাসপাতালে তিন ঘণ্টা লাইন দিতে পারে ডাক্তার দেখাতে, সে-ই গরিব।’
গ্যাসে ভর্তুকির প্রশ্নে গরিব তাঁরাই, যাঁরা ভর্তুকি না দিলে গ্যাস ব্যবহার করবেন না। ভারতের গ্রামে ৮০ শতাংশ বাড়িতে এখনও রান্নার জন্য কাঠকুটোর উপর নির্ভরতা বেশি। যোজনা কমিশনের গত বছরের একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, শহর-গ্রাম মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মাত্র ১৮ শতাংশ বাড়িতে গ্যাস রয়েছে। কাঠকুটো, পাটকাঠির উপর নির্ভরশীল প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবার। বিনিপয়সায় মেলে বলে এগুলো চলে আসছে, কিন্তু তা মেনে নেওয়া চলে না তিনটি কারণে। এক, বন নষ্ট হচ্ছে। দুই, জ্বালানি থেকে দূষণে স্বাস্থ্য, বিশেষত মেয়েদের স্বাস্থ্য নষ্ট হচ্ছে। আর তিন, প্রচুর কার্বন উৎপন্ন হচ্ছে, যা পৃথিবীর পক্ষে ক্ষতিকর। এই তিনটি ক্ষতি থামাতে, গ্রামের লোকেরা যাতে গ্যাসে রান্না শুরু করেন, সেটাই ভর্তুকির উদ্দেশ্য।
সেই নিরিখে তাঁরাই ধনী, যাঁরা ভর্তুকি বন্ধ করলে কাঠে রান্নায় ফিরে যাবেন না। গ্যাসেই রান্না করবেন। এই অর্থে ব্যাঙ্ক কর্মী-শিক্ষক-কেরানিও ধনী। তাঁরা ভর্তুকির অধিকারী নন।
ভর্তুকির খাতে খরচ কমানোর কথা বলছে সরকার। কিন্তু সেটা তার উদ্দেশ্য হতে পারে না। গ্যাসে ভর্তুকির টার্গেট সে-ই, যে গ্যাস ব্যবহার করে না, বা ভর্তুকি না পেলে গ্যাস ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। ধনীর গ্যাসে ভর্তুকি বন্ধ করে তা গরিবকে দেওয়াই সরকারের কাজ। আর তা-ই যদি হয়, তা হলে বিত্তবানকে ‘চয়েস’ দেওয়া সরকারি নীতি হয় কী করে?
হয়তো এই ‘চয়েস’ এক রকম পরিহাস। এত দিন শহুরে মধ্যবিত্ত সরকারকে বলে এসেছে, তুমি গ্রামের গরিবের জন্য কী করছ? এখন সরকার প্রশ্নটা উল্টে দিয়ে বলছে, তুমিই বা কী করছ? এ এক রকম উল্টো চাপ। চুপচাপ থেকে যা এড়িয়ে যাচ্ছে অধিকাংশ লোক।
অভিজিৎবাবু ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)’তে অর্থনীতির শিক্ষক