বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ। স্বদেশ চট্টোপাধ্যায় (বাঁ দিকে) ও রণেন সেন। ফেব্রুয়ারি ’১৫
ভারত মার্কিন পরমাণু চুক্তি নিয়ে ইতিমধ্যে কয়েকখানা মহাভারত লেখা হয়েছে, এখনও পাতার পর পাতা ভরাট হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা চুক্তির বিভিন্ন ধারা নিয়ে চুলচেরা বিচার করে চলেছেন। ক্রমাগত স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ: পরমাণুু চুক্তি সফল করার পিছনে ডিসি-তে ভারতীয় লবির ভূমিকা। এবং বাঙালির।
ভারতে নিযুক্ত বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড রাহুল বর্মা তখন বুশ প্রশাসনে অ্যাসিস্টান্ট সেক্রেটারি। ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ। মনমোহন সিংহ বুশের সঙ্গে সেই প্রসঙ্গেই বৈঠক করতে যাবেন ওয়াশিংটন ডিসি। স্থানীয়রা বলেন ডিসি। মার্কিন দেশের পশ্চিম প্রান্তের ওয়াশিংটন রাজ্য থেকে পুবের শহর ওয়াশিংটনকে আলাদা করার জন্য। রিচার্ডের বাবার আবদার ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে যে, তাঁর পরিবার জালন্ধর থেকে এসেছে। ১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসা এক অধ্যাপক তাঁর পুত্রকে নানান অনুরোধেও রাজি করাতে পারেননি এই সামান্য কথাটা বলানোর জন্য। কিন্তু রিচার্ড ভাবতেই পারেননি, তিনি না চাইলেও এই প্রসঙ্গ উঠবেই।
পারমাণবিক চুক্তি সফল করার পিছনে যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল, সেই প্রশাসনিক কর্তা এবং ভারতীয়দের লবির সদস্যদের সঙ্গে সান্ধ্যভোজে মনমোহন সিংহের সামনে রিচার্ড উপস্থিত। অভ্যাগতদের সঙ্গে পরিচয়পর্বে মনমোহনের প্রশ্ন, ‘আপনি কি ভারতীয় বংশোদ্ভূত? ভারতে কোথায় বাড়ি আপনার?’ ‘জলন্ধর।’ শুনে প্রধানমন্ত্রী বুশের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমরা এক জায়গার লোক।’ রিচার্ড অবশ্য মনে করেন না এই ‘এক জায়গা’র নৈকট্যের কোনও গুরুত্ব আছে। তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয়, মানসিকতায় অনেক বেশি মার্কিন। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
ভারতে পা দেওয়ার এক মাসের মধ্যেই কয়েক দিনের জন্য সম্প্রতি কলকাতায় কাটিয়ে গেলেন রিচার্ড রাহুল বর্মা। ডিসেম্বর মাসে তাঁকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আর জানুয়ারিতেই দায়ভার নিয়ে দিল্লি। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ‘নিউক্লিয়ার’ ভ্রমণ সার্থক করে তোলা দিয়ে রাষ্ট্রদূত হিসাবে ভারতবাস শুরুর চাপটা তাঁর নিজের কথাতেই ছিল ‘দমবন্ধ করে দৌড়’-এর। আর কলকাতা ভ্রমণ ছিল একটা হাঁফ ছাড়ার সুযোগ। এবং সেই সুযোগেই তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্বদেশ চট্টোপাধ্যায়ের ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির উপর লেখা একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। সেই ছোট্ট অনুষ্ঠানে এই গল্পটি তাঁরই মুখে শোনা।
ভারত-মার্কিন সম্পর্ক প্রসঙ্গে এই গল্পটি শুধুই একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়, এর ব্যাপ্তি বৃহত্তর। যেমন, এই যে নৈকট্যের গল্প রিচার্ড বললেন, দীর্ঘদিন তার কিন্তু কোনও প্রতিফলন ছিল না ভারত-মার্কিন সম্পর্কে প্রবাসী ভারতীয়দের লবির ভূমিকায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয়দের অ্যাসোসিয়েশনের সংখ্যা কম নয়। তাদের মার্কিন রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগও কম নয়। কিন্তু এই সংস্থাগুলি কখনওই ভারত-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তারা মার্কিন দেশে নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। মার্কিন ইতিহাসে পোখরান-উত্তর পর্বেই ভারতীয় লবি প্রথম নাক গলায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে।
ভারতের সঙ্গে ‘দূরত্ব’টা অবশ্য কেবল ভারতীয় লবির ছিল না, ছিল বারাক ওবামারও। আজ প্রেসিডেন্ট হিসাবে যে ওবামা চুক্তির শেষ পর্বের যাত্রা শুরু করে দিয়ে গেলেন, সেই ওবামাই কিন্ত মার্কিন সেনেটের সদস্য থাকাকালীন সেনেটর জেসি হেল্মস-এর সঙ্গে আদ্যন্ত ভারতবিরোধী বলেই পরিচিত ছিলেন। তাঁদের বিরোধিতায় এই চুক্তি তার জন্মলগ্নেই মৃত বলে ঘোষিত হওয়ার পথে পা বাড়িয়ে ফেলেছিল। এবং মৃত্যুর মুখ থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার পিছনে যাঁদের হাত ছিল তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দুই বাঙালি।
রাষ্ট্রদূত বর্মার কথায়, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন রাষ্ট্রদূত রণেন সেন এবং প্রবাসী স্বদেশ চট্টোপাধ্যায়ের অক্লান্ত পরিশ্রম ছাড়া সেনেটর হেল্মসকে কেউ ভারতের পক্ষে টানতে পারত না।’ সেনেটর হেল্মস ছিলেন মার্কিন বিদেশ নীতি সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির প্রধান এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিক। এতটাই, যে তাঁর মতামত অনেকটাই নির্দিষ্ট করে দিতে পারত মার্কিন পররাষ্ট্র বিষয়ক চুক্তি।
আমরা ভারতীয়রা মার্কিন রাজনীতিতে ভারত-বিরোধিতাকে ঠান্ডা যুদ্ধের দুর্মর ঐতিহ্য হিসাবেই দেখে থাকি, মনে করি ওটা একটা স্বতঃসিদ্ধ। ঠিক যে ভাবে এ দেশের বাম রাজনীতিতে মার্কিন বিরোধিতাকে দেখা হয়ে থাকে। এই ধারণাকে বদলে দেওয়ার জন্য যে লবি-র দরকার ছিল, প্রবাসী ভারতীয়রা কোনও দিন সেই পথে হাঁটেননি। ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির জন্য মার্কিন-নিবাসী ভারতীয়রা সংঘবদ্ধ হতে পারলে কী হতে পারে, সেটা বোঝার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল ১৯৯৮ সালের পরমাণু বিস্ফোরণের।
পোখরানের পর পরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে। আর শুরু হয় ভারতের দিক থেকে এই নিষেধাজ্ঞা নরম এবং একেবারে নাকচ করার প্রচেষ্টা। এরই ফল ছিল প্রেসিডেন্ট বুশের সঙ্গে মনমোহন সিংহের বৈঠক। ২০০৫ সালে। ২০০৬ সালে বুশ আসেন ভারতে। ঘোষণা হয় ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির রূপরেখা। কঠিন যাত্রার অবসান।
এবং কঠিনতর যাত্রার সূচনা। মার্কিন রাজনীতিতে এই চুক্তিকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনতে প্রয়োজন কংগ্রেসের দুই কক্ষের সম্মতি। কিন্তু তৎকালীন পরিস্থিতিতে ভারতের দিকে ঝুঁকে এই চুক্তিতে সিলমোহর দেওয়ার সাংসদের সংখ্যা তখন মাত্র কয়েক জন।
রণেন সেন তখন ভারতের রাষ্ট্রদূত। রণেনবাবুই স্বদেশ চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করেন। জানতে চান কী ভাবে মার্কিন কংগ্রেসকে ভারতমুখী করে তোলা যায়। একটা পথ অবশ্যই ছিল ভারতীয়দের সংস্থাগুলির সাহায্য চাওয়া। কিন্তু তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অর্ন্তদ্বন্দ্ব কাটিয়ে কাজের কাজ করানো সময়সাপেক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এরই প্রেক্ষিতে ঠিক হয়, শুধু এই চুক্তি নিয়ে লবি করার জন্য প্রভাবশালী ভারতীয় মার্কিনদের নিয়ে একটি গোষ্ঠী তৈরি করা হবে। এই গোষ্ঠীতে অন্যান্য ভারতীয়দের সঙ্গে স্বদেশ চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও ছিলেন আর এক চট্টোপাধ্যায়। পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়।
রাজনৈতিক বিশ্বাসে এঁরা কেউ ডেমোক্র্যাট, কেউ বা রিপাবলিকান। পেশায় কেউ ডাক্তার, কেউ বা ব্যবসায়ী অথবা পেশাদার। কিন্তু লক্ষ্য এঁদের এক: সেনেটরদের সঙ্গে কথা বলে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তিকে বাস্তব করে তোলা। স্লোগান: ‘ডিসি চলো।’ ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম কোনও রাজনৈতিক লক্ষ্যে মিছিল না করে কোটপ্যান্ট পরে ভারতীয়রা এক যোগে শুরু করলেন সেনেটরদের বোঝানোর কাজ।
এক দিকে যখন প্রবাসী ভারতীয়রা ব্যস্ত সেনেটরদের বোঝাতে যে, ভারত পরমাণু বোমা নিয়ে যুদ্ধে নামতে ব্যগ্র নয়, অন্য দিকে তখন ভারত সরকারও সেনেটরদের বোঝাতে পেশাদার লবি সংস্থাকে নিয়োগ করে হাওয়া ঘোরানোর চেষ্টায় রত। রিচার্ড বর্মার কথায়, স্বদেশ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রবাসী ভারতীয়দের এই লবির অক্লান্ত পরিশ্রমই জে সি হেল্মসের ভারতবিদ্বেষকে প্রশমিত করে চুক্তিমুখী করে তোলে। এবং তা করতে সেনেটরের সঙ্গে টানা প্রায় এক সপ্তাহ লেগে থাকতে হয়েছিল শুধু এইটুকু বোঝাতে যে, ভারতের পরমাণু প্রযুক্তি ব্যবহারে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কোনও প্রমাণ নেই।
লবির কাজ শুরু হওয়ার প্রথম পর্যায়ে নিউ ইয়র্কের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সাংসদ গ্যারি অ্যাকারম্যান-এর প্রতিক্রিয়াই বলে দেয় ভারত নিয়ে মার্কিন সংসদের মনোভাব। ‘প্রেসিডেন্ট বুশ ভারতে গিয়ে যা খুশি বলে আসতে পারেন, কিন্তু মার্কিন কংগ্রেস থেকে এই চুক্তি পাস হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।’ রিপাবলিকান সেনেটর জে সি হেল্মসের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল আরও তীব্র।
কিন্তু প্রবাসী ভারতীয়দের নিরন্তর লবি, ভারতের পক্ষে যুক্তি এই মনোভাবকেই বদলে ২০০৮ সালের ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তিকে বাস্তব করে তোলে। এই লবি তৈরি হয়েছিল শুধু পরমাণু চুক্তির কথা ভেবেই। কিন্তু এই লবি প্রমাণ করেছে মার্কিন রাজনীতি সাধারণ ভাবে ভারতের বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সাধারণ অজ্ঞতার গভীরতা। এবং ইজরায়েল যে ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের লবিকে ব্যবহার করে ঠিক সেই ভাবে ভারত কোনও দিন প্রবাসীদের লবি তৈরির ব্যাপারে এগিয়ে যায়নি। রণেন সেনের দিক থেকে চুক্তিটিকে বার করার জন্য এই পদক্ষেপ সেই দিক থেকে এক রেকর্ড।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ভারতবিদ্বেষ নিয়ে আমাদের অভিযোগ থাকতে পারে। কিন্তু অভিযোগে নিজেদের আটকে না রেখে পরমাণু চুক্তি থেকে শিক্ষা নেওয়াটা বোধহয় কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। প্রবাসীরা কিন্তু এ ব্যাপারে অনাগ্রহী না-ও হতে পারেন। যেমন হননি পরমাণু চুক্তিকে বাস্তব করতে নিরন্তর লবি করতে। তাঁরা যে এক জায়গার লোক। ভারতকে এটা বুঝতে হবে পরমাণু চুক্তির অভিজ্ঞতা থেকেই।
সূত্র: বিল্ডিং ব্রিজেস: হাউ ইন্ডিয়ান অ্যামেরিকানস ব্রট দি ইউনাইটেড স্টেটস অ্যান্ড ইন্ডিয়া ক্লোজার টুগেদার, স্বদেশ চ্যাটার্জি।