প্রবন্ধ ১

ভারতে কি সত্যি অনেক ধনী আছেন?

ভারতের মতো একটা গরিব দেশে যত জন মহা-ধনী থাকা প্রত্যাশিত, বাস্তবে তেমন বড়লোকের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। কালো টাকার কথা মনে রাখলে, সম্ভবত আরও বেশি। সে দিকে নজর রাখলে না-জানা গল্পের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।ভারতের মতো একটা গরিব দেশে যত জন মহা-ধনী থাকা প্রত্যাশিত, বাস্তবে তেমন বড়লোকের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি। কালো টাকার কথা মনে রাখলে, সম্ভবত আরও বেশি। সে দিকে নজর রাখলে না-জানা গল্পের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

Advertisement

মৈত্রীশ ঘটক ও দেবরাজ রায়

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৯
Share:

দিনকয়েক আগে খবরের কাগজে বেরিয়েছে, গোটা দুনিয়ায় মাল্টি-মিলিয়নেয়ারের সংখ্যার নিরিখে ভারত আট নম্বরে রয়েছে। মাল্টি-মিলিয়নেয়ার মানে এমন মানুষ, যাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ অন্তত দশ মিলিয়ন, মানে এক কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে, ষাট কোটির কাছাকাছি। নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ নামক একটি সংস্থা যে ওয়েলথ ইনডেক্স, মানে সম্পদের সূচক, তৈরি করেছে, তাতেই জানা গিয়েছে, ভারতে এমন ‘ষাট কোটি’-পতি বা অতি-ধনীর সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন, জার্মানি বা ব্রিটেনের তুলনায় কম বটে, কিন্তু কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া বা ফ্রান্সের থেকে বেশি। কিন্তু ভারতের জনসংখ্যা যেহেতু চিন ছাড়া আর সব দেশের থেকে বেশি, তাই অতি-ধনীই হোক বা দরিদ্র, সর্বশ্রেণির মানুষের সংখ্যাই ভারতে প্রচুর। তাই, প্রশ্ন হল, ভারতে জনসংখ্যার নিরিখে ধনীর সংখ্যা কি অন্য দেশের থেকে বেশি? গোটা দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষও যেহেতু বাস করেন ভারতেই, ভারতীয় হিসেবে ধনীর সংখ্যার প্রাচুর্যের খবরে আমরা আনন্দিত হব, না কি চরম আর্থিক বৈষম্যের প্রতিফলন ভেবে উদ্বিগ্ন হব?

Advertisement

ভারতকে নিয়ে একটা বড় মুশকিল হল, দেশটা এমনই বড় যে কোনও পরিসংখ্যান দেখেই চোখে ঝিলিমিলি লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। এবং, সেই সংখ্যাটার মানে আসলে কী, সেটা কম না বেশি, নাকি সত্যিই বিস্ময়কর, সংখ্যা দেখে সেটা বোঝা কঠিন কাজ। অনেকেই সেটা বুঝতে পারেন না। সেই কঠিন কাজটা সহজ করে নেওয়ার একটাই মন্ত্র আছে: ‘ভারত-সংক্রান্ত যে কোনও আপাতবিশাল পরিসংখ্যান পেলে প্রথমেই তাকে দেশের মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে দেখুন।’ দেখবেন, অনেক পরিসংখ্যানই অনেক বেশি অর্থবহ হয়ে উঠছে।

ধনীদের নিয়ে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েলথ (http://www.nw-wealth.com) সংস্থাটি থেকে। জানা যাচ্ছে, গোটা দুনিয়ায় অতি-ধনীর সংখ্যা ৪৯৫,০০০। তার মধ্যে ভারতের নাগরিক ১৪,৮০০ জন। অর্থাৎ, বিশ্বের ধনীদের তিন শতাংশ ভারতীয়। এ দিকে, বিশ্বের জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ ভারতীয়। এই দ্বিতীয় পরিসংখ্যানটি দেখার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হচ্ছে না, ভারতে ধনীর সংখ্যা তুলনায় কম?

Advertisement

কিন্তু, দেশ হিসেবে ভারত দরিদ্র। কাজেই, ধনী দেশগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ তুলনায় লাভ নেই। আমরা বরং দেখি, ভারতের আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী এ দেশে যত জন ধনী থাকা প্রত্যাশিত, সত্যিই কি তত জন ধনী ভারতে আছেন? ভাল ভাবে এই হিসেব বুঝতে গেলে অঙ্ক কষতে হবে। সেই ঝামেলায় না গিয়ে, এখানে কাজ চালানোর মতো কিছু হিসেব কষে দেখা যাক বরং।

২০১২ সালে যখন ভারতে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৫৫০ ডলার, গোটা দুনিয়ায় সেই গড় ছিল ১০,২৩৫ ডলার। অর্থাৎ, ভারতে মাথাপিছু গড় আয় দুনিয়ার গড়ের মাত্র ১৫ শতাংশ। অন্য দিকে আবার, বিশ্বের ধনীদের যত শতাংশ ভারতীয় (৩ শতাংশ), তার সঙ্গে বিশ্বের জনসংখ্যায় যত শতাংশ ভারতীয় (১৭ শতাংশ), তার অনুপাত হল ০.১৭। খেয়াল করে দেখুন, গড় আয়ের অনুপাত আর ধনীর অনুপাতের সংখ্যা দুটি মোটামুটি কাছাকাছি ০.১৫ আর ০.১৭ যদিও প্রথমটির তুলনায় দ্বিতীয়টি একটু বেশি। কাজেই, বলা যেতে পারে ভারতে ধনীর সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের চেয়ে একটু বেশি।

দুনিয়ার আরও কয়েকটা দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ভারতের অবস্থা আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝা যেতে পারে। চিনে মানুষের গড় আয় দুনিয়ার গড় আয়ের ৫৬ শতাংশ, আর অতি-ধনীর সংখ্যা দুনিয়ার ২৮ শতাংশ। কাজেই, চিনে অতি-ধনীর সংখ্যা প্রত্যাশার তুলনায় অনেকটাই কম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অতি-ধনীর সংখ্যা প্রত্যাশার তুলনায় অনেক বেশি। সুইটজারল্যান্ডে আরও বেশি।

তবে এই ধরনের তুলনার মধ্যে একটা সমস্যা আছে। গড় আয় যত কম হবে, আপেক্ষিক বৈষম্যের মাত্রা যদি একও থাকে, জনসংখ্যায় ধনীদের আপেক্ষিক গুরুত্ব আনুপাতিক ভাবে না কমে সাধারণত একটু বেশি-ই হারে কমে। ধরুন দুটো স্কুলের অঙ্ক পরীক্ষার ফলের তুলনা হচ্ছে। স্কুল দুটোর ছাত্র সংখ্যা সমান, এবং ছাত্রদের মধ্যে অঙ্কে পারদর্শিতার আপেক্ষিক বিন্যাসও এক, কিন্তু তার একটার গড় নম্বর অন্যটার অর্ধেক। তার মানে কি, যারা খুব ভাল করেছে (৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে) সেই ছাত্রদের সংখ্যাও কি অর্ধেক হবে? সাধারণত তা হয় না, তার একটু কমই হয়। এই ব্যাপারটা আমরা যদি নিয়ন্ত্রণ করি, তা হলে কিন্তু ছবিটা খানিক পাল্টায়।

যে অঙ্কের পথ ধরে গেলে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়, তার বিবরণ এই লেখার পক্ষে একটু বেশি খটোমটো হয়ে যাবে। এই নিয়ে আমরা অন্যত্র বিশদ আলোচনা করেছি (http://debrajray.blogspot.in)। এখানে সেই হিসেবের ফলাফলটুকু জানাই। মিলিয়নেয়ার বা দশ লক্ষ ডলারের মালিক (ভারতীয় টাকায় ছয় কোটির কাছাকাছি), যাঁদের আমরা ‘ধনী’ বলতে পারি, ভারতে তাঁদের সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় বেশি নয়। কিন্তু, অতি-ধনীর (এক কোটি ডলারের মালিক) সংখ্যা বেশ খানিকটা বেশি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে প্রত্যাশিত হারের প্রায় দেড়গুণ। অন্য ভাবে বললে, ভারতের আর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখে দেশে যত জন অতি-ধনী থাকা উচিত, অতি-ধনীর প্রকৃত সংখ্যা তার তুলনায় বেশি।

একটু অন্য ভাবেও দেখতে পারেন। ধরা যাক, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া সুদের গড় হার বছরে ১০ শতাংশ। সুতরাং, এক কোটি ডলারের মালিক এক জন ভারতীয় বছরে ১০ লক্ষ ডলার সুদ পান বা আয় করেন। হিসেবের খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, ধনী, অতি-ধনী এই শ্রেণির সবাই এই গোত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্যে যে ন্যূনতম সম্পদের প্রয়োজন ঠিক ততটারই মালিক। ভারতে গড় মাথাপিছু আয় বছরে ১৫৫০ ডলার। জাতীয় আয়ের কত শতাংশ অতি-ধনীরা অর্জন করেন তা যদি হিসেব করি, তা হলে দেখব সারা পৃথিবীর গড়ের থেকে তা সামান্য বেশি (যথাক্রমে, ০.৮ এবং ০.৭ শতাংশ)। ধনীদের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো জাতীয় আয়ের কত শতাংশ ভারতে ধনীরা অর্জন করেন তা যদি হিসেব করি, তা হলে দেখব সারা পৃথিবীর গড়ের থেকে তা খানিকটা কম (যথাক্রমে, ১.৩ এবং ১.৬ শতাংশ)। এ বার যদি মহা-ধনীদের (মোট সম্পদ ৩ কোটি ডলারের বেশি) দেখি, তা হলে আবার ভারতের জাতীয় আয়ে তাদের ভাগ সারা পৃথিবীর গড়ের থেকে বেশি (যথাক্রমে, ০.৪১ এবং ০.২৭ শতাংশ)।

বৈষম্যের দিক থেকে দেখলে ভারতের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার আরও কতকগুলো কারণ আছে। আমরা যে হিসেব কষেছি, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতের তুলনা করেছি আমেরিকার সঙ্গে। তাতেও দেখা যাচ্ছে, ভারতে অতি-ধনীর সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এ দিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটাতেই আর্থিক অসাম্য রীতিমত চড়া। জাপান বা জার্মানির মতো দেশে অতি-ধনী মানুষের সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় কম। সিঙ্গাপুর, হংকং এবং সুইটজারল্যান্ডে আবার অতি-ধনীর সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় ঢের বেশি।

দ্বিতীয় কারণটা আরও মারাত্মক। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ২০১০ সালের একটা সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, ভারতের অর্থনীতির যে অংশটি কালো টাকায় চলে, যাকে ছায়া-অর্থনীতি বলা হয়, তার অনুপাত অন্তত ২০ শতাংশ, যেখানে আরও সচ্ছল দেশগুলোতে তা ১০ শতাংশের বেশি নয়। সবাই মনে করেন, ভারতের ক্ষেত্রে এই অনুপাত আসলে ২০ শতাংশের অনেক বেশি। ইউপিএ সরকারের নির্দেশে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি ভারতের কালো অর্থনীতি বিষয়ে যে রিপোর্টটি তৈরি করেছিল, ২০১৩ সালে সরকারের হাতে তা জমা পড়ার পরেও চিদম্বরম বা অরুণ জেটলি যে রিপোর্টটিকে সংসদে পেশ করেননি, সম্প্রতি তার ভিতরের খবর জানার দাবি করল একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্র। সেই রিপোর্ট নাকি বলছে, ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন যত, দেশের কালো অর্থনীতির মাপ তার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ। এই ৭৫ শতাংশের হিসেবটাকে একেবারে কথার কথা বলে উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল। ফলে, ভারতে অতি-ধনীদের আসল সংখ্যা আমাদের হিসেবের চেয়ে আরও বেশিই হবে।

অনেকের কাছে হয়তো অতি-ধনী বা মহা-ধনীর সংখ্যাধিক্য সুসংবাদ বলে গণ্য হবে। আমরা ততখানি আশাবাদী নই। বরং, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর রঘুরাম রাজন সম্প্রতি ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বিপদের কথাটি যে ভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমরা তার সঙ্গে একমত।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, আমাদের মূল বক্তব্য হল ভারত দুনিয়ার গড়ের তুলনায় গরিব, তাই ভারতে স্বাভাবিক ভাবেই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশ্বের গড়ের তুলনায় বেশি, এবং ধনী মানুষের সংখ্যা বিশ্ব-গড়ের তুলনায় কম। কিন্তু, ভারতে লোকসংখ্যা এমনই বেশি যে ভারতের যে কোনও পরিসংখ্যানই চোখধাঁধানো, এবং অনেক সময়ই বিভ্রান্তিকর। কাজেই, যে কোনও ক্ষেত্রেই ভারতের পরিসংখ্যানকে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনা করার আগে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে ‘মাথাপিছু হিসেব’ কষে নেওয়া ভাল। সেই হিসেবই বলছে, ভারতে ‘ধনী’-র সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের কাছাকাছিই আছে, কিন্তু ‘অতি-ধনী’-র সংখ্যা প্রত্যাশিত হারের তুলনায় অনেকটা বেশি। কাজেই, ভারতের সবচেয়ে ধনী লোকরা ঠিক কী করছেন, সে দিকে নজর রাখলে কিছু না-জানা গল্পের সন্ধান পাওয়া যেতেও পারে বলেই মনে হয়। বাজিয়ে দেখতে ক্ষতি কী?

মৈত্রীশ ঘটক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এ অর্থনীতির শিক্ষক। দেবরাজ রায় নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি-তে অর্থনীতির শিক্ষক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement