আদালত যখন রাজ্য সরকারের নিকট জানিতে চাহে, আলুর অতিরিক্ত ফলন ও তাহার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষকদের অসহায় অবস্থা দূর করিতে রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ করিয়াছে, তখন এক মুহূর্ত থমকাইয়া দাঁড়ানো বিধেয়। চার মাস চাষের পর ফসলের দাম না পাইলে কৃষকদের অবস্থা কেমন হয়, দুইটি সাম্প্রতিক আত্মহত্যা তাহার সাক্ষী। হৃদয়ের তন্ত্রীতে করুণ সুর বাজাই স্বাভাবিক। কিন্তু, এই প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার কী করিতেছে, তাহা জানিতে চাওয়া আদালতের এক্তিয়ারে পড়ে কি না, সেই প্রশ্নটিও একই রকম স্বাভাবিক। সরকারের কী করণীয়, সরকার তাহা করিবে কি না, প্রশ্নগুলি অবশ্যই জরুরি কিন্তু, সব জরুরি প্রশ্নের উত্তর দাবি করিলে তাহা আদালতের সীমিত সময়ের উপর নাকি অত্যাচার হইবে। এই অতিসক্রিয়তা, প্রকৃত বিচারে, গণতন্ত্রের পক্ষেও শুভ নহে। এক দিকে তাহা আদালতের জরুরি কাজে ব্যাঘাত ঘটায়, আর অন্য দিকে তাহা গণতন্ত্রের অপর স্তম্ভ শাসনবিভাগের কাজেও হস্তক্ষেপ করে। কাজেই, মহামান্য আদালত ভাবিয়া দেখিতে পারে, ইহাই তাহার সময় ও মেধার শ্রেষ্ঠ ব্যবহার কি না।
আদালতে যখন ২০১২ সালে দায়ের করা ৭৯ জন আলুচাষির আত্মহত্যা বিষয়ক মামলার শুনানি চলিতেছিল, তখনই এই বত্সরের দুইটি আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। ইহাকে ‘সমাপতন’ বলিলে শব্দটির অপপ্রয়োগ হইবে। ইহাই স্বাভাবিক, কারণ পশ্চিমবঙ্গে আলুর বাজারটি সম্পূর্ণ অকেজো। এক বত্সর আলুচাষিরা সামান্য দামও পাইবেন না, আর অন্য বত্সর আলুর দাম এত চড়িয়া থাকিবে যে মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস উঠিবে, আলুর বাজার এমনই বীভত্স একতালীয় গতিতে চলিতেছে। দাম পড়িয়া গেলে সরকার ‘ন্যায্য মূল্যে’ আলু কিনিতে বাজারে নামে, আর দাম বাড়িলে সরকারি লরি হইতে ভর্তুকি দেওয়া দামে আলু বেচে। অর্থাত্, আলুর দাম বাড়ুক বা কমুক, সরকার নিজের কোষাগারের টাকা খরচ করিয়া অসুবিধায় পড়া জনগোষ্ঠীকে ত্রাণ করে। ইহা আপত্কালীন ব্যবস্থা হইতে পারে, কিন্তু যে সমস্যা প্রতি এক বত্সর অন্তর ফিরিয়া আসে, এই পথে তাহার সমাধান সম্ভব নহে। কথাটি রাজ্যের শাসকরা জানিলেও মানিবেন না, কারণ এক বার মানিয়া নিলে যাহা করিতে হয়, সে পথে হাঁটিবার মতো মেরুদণ্ডের জোর সাবেক বামপন্থীদেরও ছিল না, বর্তমানে ক্ষমতাসীন নব্য বামপন্থীদেরও নাই।
সমাধানের একটিই পথ— বাজারের সংস্কার। খুচরা ব্যবসায়ে সংগঠিত বিনিয়োগ চাই, চুক্তিচাষ চাই। কৃষক যাহাতে বাজারের চাহিদা-জোগানের সমীকরণের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করিতে পারে, সেই ব্যবস্থা করিতে হইবে। আলু কেনা-বেচা সরকারের কাজ নহে। চাষিরা যাহাতে বাজারের অংশী হইতে পারেন, তাহা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাহার পরিকাঠামো নির্মাণ করিতে হইবে। কৃষক যাহাতে সহজে বাজারে পৌঁছাইতে পারেন, তাহার জন্য সড়ক নির্মাণ করিতে হইবে। অধিকতর হিমঘর প্রয়োজন। মহকুমা স্তরে কৃষিপণ্যের সংগঠিত, পাইকারি বাজার প্রয়োজন। এই কাজগুলি যাহাতে হয়, সরকার তাহা নিশ্চিত করুক। কিন্তু, এই কাজগুলি লোক দেখাইয়া করা কঠিন। বরং, সরকার টাকার ঝাঁপি লইয়া কৃষকদের বাঁচাইতে নামিয়াছে, এমনটা দেখাইতে পারিলে ভোট পাইতে সুবিধা হয়। অতএব, ভোটের পূজাই চলিবে। তাহাতে মূল সমস্যার গায়ে আঁচড় না লাগিলেই বা কী?