মরাঠা অধ্যুষিত মহারাষ্ট্রের ব্রাহ্মণ মুখ্যমন্ত্রী পদে দেবেন্দ্র ফডনবীশ এবং জাঠ অধ্যুষিত হরিয়ানায় অ-জাঠ মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল খট্টরের অভিষেকের পরে জনজাতিপ্রধান রাজ্য ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম বারের জন্য নিরঙ্কুশ জয় অর্জন করিবার কৃতিত্ব লাভ করিয়া বিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলিয়া ধরিল রঘুবর দাসকে, যিনি এই রাজ্যের প্রথম অ-জনজাতীয় মুখ্যমন্ত্রী। স্পষ্টতই, ইহা বিজেপির সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন রাজ্যে আইডেন্টিটি বা পরিচিতিভিত্তিক রাজনীতির নকশাটিকে চ্যালেঞ্জ করিবার নূতন পন্থা। সত্তাপরিচয়ের ভিত্তিতে দীর্ঘ দিন যাবত্ নির্মিত ভোট-রাজনীতির সমীকরণটি খণ্ডন করিয়া কী ভাবে সত্তাপরিচয়-খণ্ডনকারী রাজনীতি তৈরি করিতে হয়, দিল্লিজয়ী নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি এখন সেই পরীক্ষায় মন দিয়াছে। বাস্তবিক, সর্বভারতীয় রাজনীতি তৈরি করিতে হইলে পথ দুইটি: এক, সত্তাপরিচয়নির্ভর দলগুলির সহিত হাত মিলাইয়া চলা; দুই, সত্তাপরিচয়ের রাজনীতির উপরে উঠিয়া সেই রাজনীতির ভাষা ও প্রকরণকে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দিবার চেষ্টা করা। গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সহিত মিলাইয়া দেখিলে যে ‘বড় ছবি’টি পাওয়া যায়, তাহাতে বিজেপি-র রাজনৈতিক পথ হিসাবে আপাতত দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটিই স্বাভাবিক।
‘বড় ছবি’র সহিত অনেক সময় ছোট ছবির কিছু গুরুতর সংঘাত থাকিয়া যায়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটিবার আভাস। যাঁহারা ঝাড়খণ্ডের ঘটনার মধ্যে রাজনৈতিক আকস্মিকতা দেখিতেছেন, তাহার বেশি কিছু দেখিতেছেন না, তাঁহাদের পক্ষেও যুক্তিটি ফেলনা নহে। জনজাতি নেতা অর্জুন মুণ্ডা যদি আসরে থাকিতেন, যদি ভোটে জিতিয়া আসিতে পারিতেন, যদি খারসাওয়ান নির্বাচনী এলাকায় বিজেপি-র অপ্রত্যাশিত পরাজয় না হইত, তাহা হইলে তিনিই মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার হইতেন, এবং সেই দাবির সামনে রঘুবর দাসের পাদপ্রদীপের আলোয় আসিবার কোনও সম্ভাবনাই থাকিত না। সমস্যা ইহাই যে অর্জুন মুণ্ডা ব্যতীত আর কোনও জনজাতীয় নেতারই রাজ্যব্যপী গ্রহণযোগ্যতা নাই, সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী পদে তাঁহাদের নাম উচ্চারিত হইবারও সম্ভাবনা নাই। এমতাবস্থায় বিজেপির সামনে যে আর কোনও পথ খোলা ছিল, তাহা নহে। এই পরিস্থিতিকে কি একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক পন্থা বলিয়া চালানো সঙ্গত?
ছোট ছবির বিরুদ্ধ যুক্তিটি অনস্বীকার্য, সন্দেহ নাই। তবে এখানে দুইটি কথা বলা প্রয়োজন। এক, এই যে অর্জুন মুণ্ডা ছাড়া আর কোনও জনজাতীয় মুখকে বিজেপি-র পক্ষে পাওয়া যাইতেছে না, ইহার মধ্যেও একটি বার্তা আছে। তাহা হইল, বিজেপি গত কিছু সময়েও ঠিক সত্তাপরিচয়ের রাজনীতিটি করে নাই, কিংবা করিয়া উঠিতে পারে নাই। এবং ইহাও স্পষ্ট যে এই রাজনীতি ছাড়াই কিন্তু এই রাজ্যে বিজেপি প্রায় ৩১ শতাংশ ভোট পাইয়াছে। অনুমান সম্ভব, ঝাড়খণ্ডের মানুষও সত্তাপরিচয়ের রাজনীতির আবর্তে কিছুটা হাঁপাইয়া উঠিয়াছেন, ২০০০ সালে নতুন প্রদেশ গঠন হইবার সময় হইতে পাঁচ জন জনজাতীয় মুখ্যমন্ত্রীকে এক বা একাধিক বার পাইয়া তাঁহারা উন্নয়ন কিংবা জাতীয়তার গর্বে তেমন গৌরবান্বিত হইতে পারেন নাই। সামাজিক স্তরে যদি এই বার্তা থাকিয়া থাকে, তবে বিজেপি-র কৃতিত্ব যে, তাহারা সেই বার্তা ঠিক ভাবে পড়িতে পারিয়াছে। দ্বিতীয়ত, যদি রঘুবর দাসকে নির্বাচনের মধ্যে বিজেপির তেমন কিছু সুচিন্তিত পরিকল্পনা না-ও থাকিয়া থাকে, মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের পর কিন্তু বিজেপি-র পক্ষ হইতে একটি স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রয়োজন, যাহা জনজাতীয় বা ইত্যাকার সত্তা-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠিয়া একটি বৃহত্তর মঞ্চ নির্মাণ করিতে সমর্থ। ইহার মধ্যেই বিজেপি-র সর্বভারতীয় গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ হইবে। এবং সত্তা-রাজনীতির ভবিষ্যত্টিও নির্ধারিত হইবে।