প্রবন্ধ ১

ফ্রি পেতে গেলে কত দিতে হবে, দাদা?

বঞ্চনা করার ষড়যন্ত্র নয়, আসলে গরিব মানুষকে তাঁর প্রাপ্য সুবিধে না দেওয়াতে নানা লোকের নানা ছোট ছোট সুবিধে এবং স্বার্থ তৈরি হয়ে আছে।কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নইলে অনাদীশ বাগদিকে সাত দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা কেন খরচ করতে হল সরকারি হাসপাতালে? বছর পঁয়ষট্টির এই চাষি বিপিএল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক নিয়ে। ১০ জানুয়ারি। অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় ৫০০ টাকায় গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু। তার পর স্যালাইন, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, খরচ বেড়েই চলেছে। তবু বহু অনুরোধে বর্ধমানে রেফার করা আটকেছেন তাঁর ছেলে।

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share:

কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। নইলে অনাদীশ বাগদিকে সাত দিনে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা কেন খরচ করতে হল সরকারি হাসপাতালে? বছর পঁয়ষট্টির এই চাষি বিপিএল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সিউড়ি জেলা হাসপাতালে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক নিয়ে। ১০ জানুয়ারি। অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় ৫০০ টাকায় গাড়ি ভাড়া থেকে শুরু। তার পর স্যালাইন, ওষুধ, ইঞ্জেকশন, খরচ বেড়েই চলেছে। তবু বহু অনুরোধে বর্ধমানে রেফার করা আটকেছেন তাঁর ছেলে। আরও খরচ টানতে পারতেন না তাঁরা। লিভারের অসুখে আক্রান্ত অবনী সিংহের দশা আরও খারাপ। পনেরো দিনে প্রায় ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে তাঁর, ওই সিউড়ি হাসপাতালেই।

Advertisement

অসুখ জটিল বলেই কি খরচ করতে হচ্ছে? তা-ও মনে হয় না। দশ মাসের প্রিয়ম সাহা কোচবিহার জেলা হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫ জানুয়ারি, নেহাতই ডায়ারিয়া নিয়ে। দু’দিন ভর্তি থাকে ওই শিশু। স্যালাইন, ওষুধ মিলিয়ে চারশো টাকা খরচ করতে হয়েছে পরিবারকে।

এরা সকলেই দরিদ্র, সকলেই ভর্তি হয়েছিল সরকারি হাসপাতালের ফ্রি বেডে। তবু যে এমন খরচ, সে কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? গবেষণা তা বলছে না। অর্থনীতির শিক্ষক অরিজিতা দত্ত ও দিল্লির এক গবেষণা সংস্থার গবেষক মন্টু বসু তামিলনাড়ু এবং পশ্চিমবঙ্গে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ কেমন, তা খতিয়ে দেখেছেন। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার তথ্য থেকে তাঁরা বলছেন, এ রাজ্যে গ্রামের সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে রোগীরা ওষুধের জন্য গড়ে খরচ করেন সাড়ে তিনশো টাকা। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য প্রায় ৬০০ টাকা। সেখানে তামিলনাড়ুর গ্রামে ওষুধের গড় খরচ— প্রায় অবিশ্বাস্য— চার টাকারও কম। আর মেডিক্যাল পরীক্ষার খরচ ২২ টাকা ৩৫ পয়সা। এ হিসেবও হল সব রকম সঙ্গতির রোগীর জন্য। কেবল গরিব রোগীর কথা ধরলে (মাসিক ব্যয়ের নিরিখে চারটি ভাগ করলে, ‘গরিব’ হল সবচেয়ে নীচের এক-চতুর্থাংশ) তামিলনাড়ুতে গ্রাম কিংবা শহরে বাস্তবিক ওষুধের জন্য একটি টাকাও খরচ হয় না। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গরিবের ওষুধের খরচ ৩০২ টাকা, আর শহরে ১৯১ টাকা।

Advertisement

তা হলে কি ‘ফ্রি’ কথাটার মানে বুঝতেই পশ্চিমবঙ্গে ভুল হচ্ছে? তামিলনাড়ুতে ফ্রি চিকিৎসা মানে ওষুধ, টেস্ট, রক্ত-স্যালাইন সব ফ্রি, আর এ রাজ্যে ফ্রি চিকিৎসা মানে কেবল বেডটাই ফ্রি, সঙ্গে বড় জোর স্যালাইন আর দু’চারটে ওষুধ-ইঞ্জেকশন?

এই গবেষণার পরিসংখ্যান অবশ্য কিছু পুরনো, ২০০৪ সালের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা থেকে নেওয়া। তার পরে সরকার চিকিৎসার খরচ কমানোর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তা হল ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান। অনাদীশ বাগদি তাঁর কিছু ওষুধ সিউড়ি হাসপাতালের ন্যায্যমূল্যের দোকান থেকে কিনেছিলেন। না হলে তাঁর খরচ আরও খানিকটা বেশি হত, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিনা পয়সায় হত না, সেটা নিশ্চিত। নানা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ করা গেল, এখন ফ্রি বেডের রোগীদের জন্য জরায়ু বাদ (হিস্টেরেকটোমি) দেওয়ার খরচ চার-পাঁচ হাজার টাকা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত (হেমাচুরিয়া) চিকিৎসার খরচ সাত থেকে দশ হাজার, রেডিয়োথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করতে লাগে ২৫-৩০ হাজার। এর মধ্যে ওষুধ-ইঞ্জেকশন, ব্যান্ডেজ, স্যালাইন, রক্ত, মেডিক্যাল টেস্টের খরচ আছে, বাড়তি থাকতে পারে আয়ার খরচ, কারণ দু’জন নার্স প্রায়ই দেড়শো রোগীর ওয়ার্ড সামলান। সরকারি কর্তাদের যুক্তি, এ সব চিকিৎসা বাইরে করাতে গেলে পাঁচ-দশগুণ বেশি খরচ হত। সরকারি হাসপাতাল বলেই এত কমে মিলছে। কিন্তু ডিসকাউন্ট মধ্যবিত্তের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে, গরিবের কাছে হবে কেন? তার তো শূন্য খরচে পাওয়ার কথা ছিল। যেমন তামিলনাড়ুর গরিবরা পান। যে উদ্দেশ্যে গরিবের জন্য ভর্তুকি দেওয়া, সে যাতে খরচের ভয়ে চিকিৎসা এড়িয়ে না যায়, চিকিৎসা করাতে গিয়ে ঋণে ডুবে না যায়, ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট দিলেও সে উদ্দেশ্য ১০০ শতাংশ ব্যর্থ হচ্ছে। মধ্যবিত্তের জন্য যা মন্দের ভাল, গরিবের জন্য তা পুরোই মন্দ।

এই ভুলটা স্পষ্ট হচ্ছে না, কারণ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের খরচের তুলনা করা হচ্ছে। এটা স্পষ্ট হবে যখন এক রাজ্যের সঙ্গে অন্য রাজ্যের সরকারি চিকিৎসার তুলনা করা হবে। কেন এ রাজ্যের হাসপাতালে ভর্তি গরিব রোগীদের ৫৮ শতাংশ ওষুধ পায়, তামিলনাড়ুতে ৯৮ শতাংশ? আমাদের ৫৪ শতাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল টেস্ট করান, আর ওদের ৮৮ শতাংশ? অথচ সেই ২০০৪ সালেও তামিলনাড়ুর ৯৭ শতাংশ সরকারি বেড ফ্রি ছিল। এ রাজ্যে তখন ফ্রি বেড মাত্র ৫৮ শতাংশ।

এখন অবশ্য জেলায় সব বেড ফ্রি। গত অক্টোবর মাসে তেমনই ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাতে হাসব, না কাঁদব? অরিজিতা এবং মন্টুর গবেষণা দেখাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গরিব রোগীদের ৮০ শতাংশই ভর্তি হন সরকারি হাসপাতালে, কিন্তু হাসপাতালের জন্য বরাদ্দ সুযোগসুবিধের ২২-২৫ শতাংশ জোটে তাঁদের। উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনী, দুই শ্রেণি মিলে পাচ্ছে ভর্তুকির ৪৪-৪৫ শতাংশ সুযোগ। এই অনুপাত যদি না বদলায়, তা হলে ফ্রি বেড বাড়লে গরিবের চাইতে বিত্তবানের জন্য ঢের বেশি খরচ হবে সরকারের। গরিবের উপকার করতে চাইলে হয়তো ফ্রি বেডের সংখ্যা কমিয়ে, সেই সব বেডের রোগীদের জন্য ওষুধ, টেস্ট-এর ব্যবস্থা বাস্তবিক ফ্রি করা বেশি দরকার ছিল।

এমন গরিব-উপযোগী ব্যবস্থা যে নেওয়া হচ্ছে না, তা কি কেবলই গরিবের শেষ সম্বলটাও কেড়ে নেওয়ার কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের জন্য? তা হয়তো নয়। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, গরিবকে সুবিধে না দেওয়াতে নানা লোকের নানা ছোট ছোট সুবিধে তৈরি হয়ে আছে। যে দালাল দুশো টাকায় জোগাড় করেন বিপিএল সার্টিফিকেট, যে কাউন্সিলর, বিধায়ক কলমের আঁচড়ে (বা ফোনের ধমকে) পেয়িং বেডকে ফ্রি করে প্রভাব দেখান, তাঁরা গরিবের মন্দ চান না। ডাক্তারও গরিব-বিদ্বেষী নন। কিন্তু সব বেড ফ্রি হলে তাঁর সুবিধে, এক বিভাগে রোগী উপচে পড়লে সহজেই অন্য বিভাগের বেড নিতে পারবেন। অ-গরিব রোগীর আত্মীয়দের সুবিধে, বেড ফ্রি হলে খরচ কমে, হ্যাপাও কমে। পেয়িং বেড হলে রোগীর তরফে কাউকে সারাক্ষণ হাজির থাকতে হবে, স্লিপ দিলেই ওষুধ, ইঞ্জেকশন, গজ-ব্যান্ডেজ জোগাতে হবে। হাসপাতাল থেকে এগুলো দিয়ে পরে দাম নেওয়ার নিয়ম নেই। তা ছাড়া, ‘সরকারি হাসপাতালে এসেছি, ফ্রি পাব না কেন,’ এই মনোভাবটাও কাজ করে। এত লোকের এত সুবিধের চাপে এমনিতেই পেয়িং বেডের সংখ্যা কমছিল। স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, গত বছর জেলা স্তর পর্যন্ত হাসপাতালে পেয়িং বেড ছিল বড়জোর ১০-২৫ শতাংশ। এ বার সেটুকুও ফ্রি হয়ে গেল। তাতে ঝামেলা কমল ঠিকই, কিন্তু বেড ফ্রি করার সুবিধে কে পাচ্ছে, কে দেখতে যাচ্ছে?

এ কেবল স্বাস্থ্যের ছবি নয়। স্কুলশিক্ষাতেও ছবিটা কাছাকাছি। সম্প্রতি এ নিয়ে প্রকাশিত ‘অসর ২০১৪’ সমীক্ষায় প্রকাশ, এ রাজ্যে সরকারি স্কুলের প্রাথমিকে অর্ধেকেরও বেশি পড়ুয়া, উচ্চ প্রাথমিকে ৭৬ শতাংশ পড়ুয়া প্রাইভেট টিউশন নিচ্ছে। সেখানে তামিলনাড়ুতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে টিউশন নেওয়ার অনুপাত ৬-৭ শতাংশ। এবং, এ রাজ্যে টিউশন ফি সে রাজ্যের চাইতে বেশি। খরচ বেশি করে বাড়তি লাভ কী হচ্ছে? মাতৃভাষায় রিডিং পড়তে পারার ক্ষেত্রে গ্রামের পড়ুয়ারা এ রাজ্যে একটু এগিয়ে, কিন্তু অঙ্কে ওরা গোড়ায় পিছিয়ে থাকলেও পরে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজিতে আবার আগাগোড়াই ওরা এগিয়ে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, ইস্কুলে আমাদের পড়ুয়ারা যাচ্ছেই কম। সমীক্ষার দিন মাত্র ৫৬ শতাংশ পড়ুয়াকে ক্লাসে দেখা গিয়েছে। তামিলনাড়ুতে ক্লাসে ছিল ৮৭-৮৯ শতাংশ পড়ুয়া। এ থেকে ইঙ্গিত মেলে, যে কোনও কারণেই হোক, এ রাজ্যে শিক্ষকদের কাছে ক্লাসে না-পড়ানোর সুবিধেটা বড় হয়ে উঠছে। ছাত্রের কাছেও টিউশনে গিয়ে পড়া বোঝা বেশি সুবিধেজনক মনে হচ্ছে।

এর ফলে অসুবিধেয় পড়ছে গরিব। যে সম্পদ গরিবের জন্য বরাদ্দ, সে ওষুধপত্রই হোক আর মানবসম্পদ (শিক্ষক, ডাক্তার) হোক, গরিব তা পাচ্ছে না, কিংবা সামান্যই পাচ্ছে। কিন্তু গরিবের না-পাওয়া, আর তার ফলে সরকারের অপচয়ের হিসেবটা কষার চাড় নেই কারও। নেতারা আরও ফ্রি পণ্য, ফ্রি পরিষেবা ঘোষণা করতে চান। বিরোধীরা চেঁচান, অত দেবে বলেছিলে, দিলে মোটে এত! মিডিয়া খোঁজে, অত দিতে গিয়ে কত কার পকেটে গেল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত গরিবকে ফ্রি পরিষেবা দেওয়ার চাকরির বিজ্ঞাপন খোঁজে। অনাদীশ বাগদিদের কী হল, কতটুকু পেল তারা, খোঁজ করতে ভুল হয়ে যায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement