গণতন্ত্র উন্নয়নের পথের কাঁটা কি না, এই প্রশ্ন উত্থাপন করিলেই যাঁহারা কানে আঙুল দেন এবং প্রশ্নকর্তার কণ্ঠরোধ করিতে চাহেন, তাঁহারা উন্নয়নের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নহেন সে কথা বুঝিতে অসুবিধা নাই। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতিও তাঁহাদের যথার্থ শ্রদ্ধা আছে কি? গণতন্ত্র অবশ্যই মহার্ঘ। তাহার মর্যাদা স্বতঃসিদ্ধ এবং স্বরাট— গণতন্ত্র যদি উন্নয়ন বা সুস্থিতি অথবা অন্য নানা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে বাধা সৃষ্টি করে, তথাপি তাহাকে খর্ব করা চলে না। কিন্তু তাহার অর্থ ইহা নহে যে, গণতন্ত্র সম্পর্কে, তাহার অনুশীলন সম্পর্কে, সেই অনুশীলনের পদ্ধতি ও পরিণাম সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা চলিবে না। যে অবাধ এবং যুক্তিনিষ্ঠ বিতর্ক গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ধর্ম, তাহাই এই প্রশ্ন তুলিবার অনুমতি দেয়, বস্তুত নির্দেশ দেয়। সকল বিষয়ে প্রশ্ন চলিতে পারে, কেবল আমার সম্পর্কে নয়— ইহা গণতন্ত্রের কথা হইতে পারে না। সুতরাং ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ সম্পর্কে চিন্তিত হইলে ঠোঁট এবং কান হইতে আঙুল সরাইয়া অপ্রিয় প্রশ্নটি তুলিতে ও শুনিতে হইবে: গণতন্ত্র কি উন্নয়নে বাধা দিতে পারে?
ইহা গভীর দুশ্চিন্তার কারণ যে, সংসদের অধিবেশন শুরু হইলেই অধুনা এই প্রশ্নটি প্রবল আকার ধারণ করিতেছে। একের পর এক অধিবেশন আসে এবং যায়, সংসদের কাজ হয় এক আনা, শোরগোল পনেরো আনা, কাজের খাতায় ফাঁকির অঙ্ক বাড়িতেই থাকে। বিভিন্ন গুরুত্বপর্ণ আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের প্রয়োজন অপূর্ণ থাকিয়া যায়, সুস্থ বিতর্কের ভিত্তিতে পথ নির্ধারণ করিয়া অগ্রসর হইবার যে পথনির্দেশ আইনসভা হইতে মিলিবার কথা, তাহা মেলে না। ক্ষমতার আসন হইতে এক পক্ষ বিদায় লয়, অন্য পক্ষ আসে, অ-কাজের ধারা বদলায় না। যখন ইউপিএ তথা কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, তখন ভারতীয় জনতা পার্টি ও অন্য নানা দল বিরোধী আসনে বসিয়া সংসদ অচল করিয়াছে। আজ এনডিএ তথা বিজেপি ক্ষমতায় আসিয়াছে, আজ কংগ্রেস ও অন্য নানা দল বিরোধী আসনে বসিয়া সংসদ বানচাল করিবার তোড়জোড় করিতেছে। নরেন্দ্র মোদী অর্ডিনান্স জারি করিয়া দেশ শাসন করিতে তত্পর, এই অভিযোগে যে বিরোধীরা মুখর, তাহারাই যদি সংসদের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়, তবে এক ধরনের দ্বিচারিতার প্রদর্শনী ঘটে না কি?
নীতিগত বিরোধিতা গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এনডিএ সরকার জমি অধিগ্রহণের যে আইন প্রণয়ন করিতে চাহিতেছে, তাহাতে বিরোধীদের আপত্তি থাকিতেই পারে। কংগ্রেসের আপত্তি অংশত বিস্ময়কর, কারণ তাহারাই জমি অধিগ্রহণের নূতন প্রস্তাব নির্মাণ করিয়াছিল। কিন্তু তাহারা সঙ্গত কারণেই বলিতে পারে যে, বিজেপি তাহাদের সেই প্রস্তাবে কৃষকের স্বার্থবিরোধী পরিবর্তন ঘটাইতে চাহিতেছে। কিন্তু আলোচনাই মতবিরোধ বা আপত্তির গণতান্ত্রিক মোকাবিলার পথ। প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার সহকর্মীরা, সম্ভবত বেগতিক দেখিয়াই, সেই পথে চলিবার প্রস্তাব দিয়াছেন, তাঁহারা জমি বিল লইয়া আলোচনায় প্রস্তুত। তাহার পরেও সংসদীয় কৌশল ব্যবহার করিয়া তাঁহারা যৌথ অধিবেশন ডাকিবার সুযোগ খুঁজিতেছেন। সংসদীয় পদ্ধতিতেই এই ধরনের কৌশলের মোকাবিলা করিতে বিরোধীরা সচেষ্ট হইতে পারেন, দোষের কিছু নাই। কিন্তু উভয় পক্ষেরই লক্ষ্য হওয়া উচিত আইন প্রণয়নের কাজটিকে আগাইয়া লইয়া যাওয়া, অচলাবস্থা সৃষ্টি নহে। বিদেশি বিনিয়োগের পথ খুলিয়া দেওয়া বা শ্রম আইন সংস্কারের মতো অন্য নানা বিতর্কিত ক্ষেত্রগুলিতেও একই যুক্তি প্রাসঙ্গিক। বিতর্কিত ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে যে গণতন্ত্র দক্ষ নহে, তাহার সম্পর্কে প্রশ্ন না তুলিলে বড় অন্যায় হয়। যাঁহারা গণতন্ত্রের অনুশীলন করিতেছেন, তাঁহাদের এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে হইবে। ইহা গণতন্ত্রের প্রতি তাঁহাদের দায়।