মাদার টেরিজাকে লইয়া কথা না বাড়াইবার অনুরোধে টুইট করিয়াছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবাল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান ভাগবত সম্প্রতি মাদার টেরিজার সেবা-ব্রতের অনুষঙ্গে খ্রিস্টীয় মিশনারি ধর্মান্তরকরণের ব্রতটির ইঙ্গিত করিয়াছেন, তাই এই বার্তা। কেজরীবাল তাঁহার বক্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন সুভদ্র ভাষায়। সুরটি আর একটু তির্যক হইতেও পারিত। সঙ্ঘপ্রধান ভাগবতের অন্যান্য ধর্মবাদের আতিশয্য বিষয়ে কথা বলিবার কতখানি অধিকার রহিয়াছে, তাহা লইয়া ব্যঙ্গ তীব্রতর হইতেই পারিত। গত কিছু কাল ধরিয়া যে নিরবচ্ছিন্ন আক্রমণ সঙ্ঘের বিভিন্ন সদস্যের গলায় ধ্বনিত হইতেছে, তাহার প্রেক্ষিতে ভাগবতের এই ‘ইঙ্গিত’ সরাসরি অভিসন্ধি-প্রসূত: কেবল কেজরীবাল কেন, গোটা দেশ বুঝিতেছে। তদুপরি, আপাতত মোহন ভাগবতরা ‘ঘর ওয়পসি’-র বন্দোবস্তেও কোমর বাঁধিয়া নামিয়াছেন, যাহা এক কথায় (পুনঃ)ধর্মান্তরকরণ ব্যতীত কিছু নয়। খ্রিস্টীয়করণ, ইসলামিকরণ ইত্যাদি যাহা কিছু তাঁহাদের অভিযোগ, হিন্দুকরণের দ্বারা তাহার প্রতিকার প্রবল উদ্যমে প্রসারিত হইতেছে। ধর্মান্তরিত হইতে যাঁহারা আসিতেছেন, তাঁহারা স্বেচ্ছায় আসিতেছেন, না কি বলপ্রয়োগ করিতে হইতেছে, ‘বল’টি কি নেহাতই পরোক্ষ প্রলোভন, না কি প্রত্যক্ষ ভীতি-প্রদর্শন, এমনকী শারীরিক নির্যাতনও বটে, এ সব ব্যাখ্যায় না গিয়া এইটুকু বলা যায় যে অন্যান্য ধর্মবাদীর অভিসন্ধি বিষয়ে ভাগবতদের প্রশ্ন তুলিবার অধিকারটিই প্রশ্নযোগ্য।
অবশ্য মূল প্রশ্নটি তাহাতে অসার প্রমাণিত হয় না। কে প্রশ্ন তুলিতেছেন, তাহা গুরুতর বিষয়। প্রশ্নের নৈতিক ও রাজনৈতিক লক্ষণ প্রশ্নকারীর অবস্থান দ্বারা অনেকাংশে নির্ধারিত হয়। কিন্তু তাহা অতিক্রম করিয়াও প্রশ্নের একটি তাত্ত্বিক মর্মও থাকে। তাই ভাগবতের ব্যক্তিগত ও দলগত অবস্থান ভুলিয়া প্রশ্নটিকে পৃথক ভাবে বিচার করাও অসঙ্গত নহে। অন্যান্য মিশনারি সংস্থার মতো মাদার টেরিজার প্রতিষ্ঠানও যে বহু অসহায় দরিদ্র মানুষের ধর্মান্তরকরণের সাক্ষী, এই প্রথম ইহা শোনা গেল না। চিকিত্সা ও আশ্রয়ের সূত্রে মিশনারি সেবা-প্রতিষ্ঠানগুলি যে ধর্মপ্রচার করিতে উত্সুক, তাহা মাত্র কয়েক শত বত্সরের পুরাতন তথ্য। দরিদ্র মানুষ অনেক সময়ই সামাজিক অনাচার অবিচার হইতে আত্মরক্ষা করিতে ধর্মান্তরের দিশাটি আঁকড়াইয়া ধরে, তাহাও বহুজ্ঞাত সত্য। তাই যখন মিশনারিরা বলেন, খ্রিস্টের সেবক হিসাবে তাঁহারা সেবার ব্রত পালন করিতেছেন, তাহার মধ্যে সেবাপরায়ণতা আছে, ধর্মমুখিতার সত্যও আছে। পরাধীন ভারতে মিশনারিরা রীতিমত প্রত্যয় ও গৌরবের সহিত এই দ্বিমুখী সত্যটি স্বীকার করিতেন। তাহাতে অগৌরবের কিছু ছিল না।
স্বাধীন ভারতে কিন্তু এই স্বীকৃতির অবকাশ নাই। মাদার টেরিজা বিষয়ে সেবা ও ধর্মপ্রচারের যুগল সত্যটি উচ্চারণমাত্রই গেল-গেল রব ওঠে। শুধু খ্রিস্টানদের মধ্যে নয়, অখ্রিস্টানদের মধ্যেও। এমনকী ধর্মনিরপেক্ষদের মধ্যেও। সংখ্যালঘুর ধর্মবোধে আঘাত লাগিবার ভয়ে প্রশ্ন তুলিবার গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি চোখ বুজিয়া থাকাই ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার দস্তুর। স্বভাবতই, পোয়াবারো হয় চরমপন্থীদের। মধ্যপন্থীরা সত্যকে সহজে লন না, তাই চরমপন্থীরাই ভালমন্দ বিচারের কারবারি হইয়া পড়েন। মানুষ দেখিতে পায়, যে সত্য সাদা চোখেই প্রত্যক্ষযোগ্য, শুধু চরমবাদীরাই তাহা দেখিতেছেন ও বলিতেছেন। ভাগবতের সূত্রে এই বিপর্যয়টি আবার সামনে আসিল।