মেডিক্যাল কলেজের আসন নিয়ে যেন সাপ-সিঁড়ি খেলা চলছে। এই সে দিন রাজ্য সরকার ঘোষণা করল, মেডিক্যালে আসনের সংখ্যা সাঁ করে উঠে যাবে ২২০০’য়। বছর না-ঘুরতেই ৭৫০ আসন বাতিল করে ১৪৫০ আসনে নামিয়ে আনছে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া। মন্ত্রী-আমলারা অভয় দিচ্ছেন, উন্নয়নের সিঁড়ি আরও লম্বা হবে। নতুন নতুন কলেজ হবে, ডাক্তারি আসন বাড়বে। সাপ লেজ আছড়াচ্ছে, এগুলো কলেজ, না ডিগ্রির দোকান? শিক্ষক নেই, লাইব্রেরি নেই, ল্যাবরেটরি নেই।
মানুষ মাথা চুলকোন, সাপ ভাল না সিঁড়ি ভাল? ডাক্তারি পড়ার চাহিদা চড়া, এ রাজ্যে জনা তিরিশ মেডিক্যালে ঢোকার পরীক্ষা দিলে সুযোগ পায় এক জন। কে না আরও আসন চাইবে? অন্য দিকে, পাড়ায় পাড়ায় ডিগ্রি-সর্বস্ব ডাক্তাররা চেম্বার সাজিয়ে বসে আছে, ভাবতেই হৃৎকম্প। তপন রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথায় বরিশালের এক কম্পাউন্ডার গম্ভীর মুখে রোগীকে পরীক্ষা করে বলেছিলেন, ‘হাঁটুতে ব্রেন নাই।’ আমাদের ডাক্তাররাও কি সেই নমুনার হবে? মন্দ কলেজ ভাল ডাক্তার তৈরি করবে কী করে?
সরকারি কলেজেও আসন বাতিল হলে তাই গোড়ায় হয় বিরক্তি। কী করছে সরকার? কেন দিতে পারছে না যথেষ্ট শিক্ষক, সরঞ্জাম? গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি সরকার উদাসীন, কৃপণ। বামপন্থীরা বরাবরই সরকারের স্বাস্থ্য-বিমুখতাকে রাষ্ট্রের গরিব-বিমুখতার সঙ্গে মিলিয়ে এসেছে। একে সরকার মেডিক্যাল শিক্ষাকে বেসরকারি ক্ষেত্রে ঠেলে দিচ্ছে (দেশের ৬০ শতাংশ এমবিবিএস আসনই বেসরকারি কলেজে) তায় সরকারি কলেজগুলোর জন্য টাকা খরচ করছে না। স্বাস্থ্যের জন্য বাজেটের তিন শতাংশও বরাদ্দ নয়। পরিকাঠামোয় ফাঁক থাকলে কাউন্সিল তো ফাঁকি ধরবেই।
কিন্তু কাউন্সিল যে ঠগ ধরতে গাঁ উজাড় করছে। এ বছর প্রায় ৮০টি মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন করেছে কাউন্সিল। দেখা যাচ্ছে, ৫৫টি কলেজে আসন বাড়ানো বা পুনর্নবীকরণের আবেদন খারিজ হয়েছে। কেরলে ৯৪টি পোস্টগ্র্যাজুয়েট আসন, অন্ধ্রপ্রদেশে ৪০০টি এমবিবিএস আসনের উপর খাঁড়া ঝুলছে। বিহারে পটনা মেডিক্যাল কলেজে ৫০টি আসন কমেছে, আরও দুটি কলেজে নতুন ছাত্র ভর্তি বন্ধ। হরিয়ানা থেকে তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র থেকে অসম, সবাই ফেল। এদের এক বড় অংশ সরকারি। মেডিক্যাল কাউন্সিলে এ রাজ্যের সদস্য সুদীপ্ত রায় বলেন, “সরকারি কলেজের প্রধান সম্পদ, হাসপাতালে প্রচুর রোগী। সেটা গণ্য না করে, ছোটখাট খামতি নিয়ে বেশি কড়াকড়ি করছে কাউন্সিল।”
কী ধরনের খামতি? সাগর দত্তে স্পিচ থেরাপিস্ট নেই, মুর্শিদাবাদে অপারেশন থিয়েটারে সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই, বর্ধমানে দুটো বেডের মধ্যে দূরত্ব দেড় মিটারের কম এমন সব কারণও আছে তালিকায়। আরও আছে: অ-চিকিৎসক কর্মীদের আবাস নেই, লেকচার থিয়েটার এসি নয়, লাইব্রেরিতে তিনশো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসার চেয়ার নেই। কেবল এমন ছোটখাটো কারণের ভিত্তিতেই আসন বাতিল হচ্ছে, এমন অবশ্যই নয়। কিন্তু এগুলো কি আসন অনুমোদনের শর্ত হতে পারে?
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ দেবী শেঠির কথায়, “তৃতীয় বিশ্বের দেশে প্রথম বিশ্বের বিধিনিষেধ আরোপ করতে চাইছে মেডিক্যাল কাউন্সিল।” তিনি নিজেও কিছু দিন ছিলেন কাউন্সিলের শীর্ষপদে। তাঁর প্রশ্ন, লন্ডনে গাইজ হসপিটাল শহরে নানা বিল্ডিংয়ে ছড়িয়ে, ছাত্ররা প্রাইভেট হস্টেলে থেকে পড়ছে, ভারতে কেন মেডিক্যাল কলেজে প্রতিটি ছাত্রের জন্য হস্টেলে আসন চাই? কেন চাই ২০ একর জমি, পাঁচিল-ঘেরা ক্যাম্পাস? ভাল ডাক্তার তৈরিতে এ সব শর্ত কোনটা, কতটা আবশ্যক, সেই বিতর্ক হওয়া দরকার।
যা নিয়ে কাউন্সিল সবচেয়ে সরব, তা হল শিক্ষকের ঘাটতি। গোটা কয়েক শিক্ষককে এক বার এই কলেজ, এক বার ওই কলেজে দেখিয়ে অনুমোদন আদায়ের চেষ্টা করছে সরকারি কলেজগুলোও, এই হল কাউন্সিলের নালিশ। শিক্ষকের সংখ্যা নিয়ে দরদস্তুর করা চলে না। কিন্তু চিকিৎসক-শিক্ষকের আকালটাও তো বাস্তব। এ দেশে পোস্টগ্র্যাজুয়েট মেডিক্যাল আসন মাত্র ২২ হাজার, এমবিবিএস আসনের প্রায় অর্ধেক। তার মধ্যেও ফরেন্সিক মেডিসিনের মতো কয়েকটি বিষয়ে আসন অত্যন্ত কম, যার ফলে মেডিক্যাল কলেজে সে সব বিষয়ের শিক্ষক মেলে না। আরও আসন চালু না হলে বিশেষজ্ঞ শিক্ষক মিলবে না, আরও শিক্ষক না মিললে আসন চালু করা যাবে না, এই চক্র থেকে বেরোবার উপায় কী?
তাই প্রশ্ন উঠছে, যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা পুরো সময়ের শিক্ষক হতে রাজি নন, তাঁরাও কেন ক্লাস নিতে পারবেন না মেডিক্যাল কলেজে? মেডিক্যাল কাউন্সিলের নিজের ‘ভিশন ২০১৫’ রিপোর্ট বলছে, ডাক্তারি শিক্ষাকে ‘বিজ্ঞান-নির্ভর’ থেকে ‘দক্ষতা-নির্ভর’ করে তোলা দরকার। তা হলে বেসরকারি ক্ষেত্রে যাঁরা সফল, নিজেদের ক্ষেত্রে যাঁদের দক্ষতা প্রমাণিত, তেমন ডাক্তাররা ছাত্রদের হাতেকলমে তালিম দেবেন না কেন?
অনেকে ভয় পাচ্ছেন, মেডিক্যাল কাউন্সিল শর্তে এক আনা ঢিলে দিলে, কলেজগুলো বারো আনা ঢিলে দেবে। কেবল পার্ট-টাইম শিক্ষক দিয়ে কলেজ চালাবে। কিন্তু এই ভয়ে কি পিছিয়ে আসা চলে? তার চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার ঘটেই চলেছে, পুরো সময়ের শিক্ষকরা কার্যত পার্ট-টাইম কাজ করছেন। ফাঁকি কমাতে পারব না বলে ছাত্রদের আসন কমাব, এ কেমন কথা? ফাঁকির উপর নজরদারি চলুক, শর্ত হোক যুক্তিযুক্ত।
মেডিক্যাল শিক্ষার শর্ত সরল করার বিপক্ষে সব চাইতে বড় যুক্তি, শিক্ষার মান, চিকিৎসার মান। মেডিক্যাল কাউন্সিল ওয়েবসাইটে লিখছে, তার দায়িত্ব চিকিৎসার উঁচু মান নিশ্চিত করে মানুষের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা রক্ষা করা। সেরা মানের চিকিৎসার জন্য প্রশিক্ষণের সেরা পরিকাঠামোই দরকার। তার জন্য যত টাকা চাই, তা দাবি করাই উচিত। সেটা অন্যায় নয়।
কিন্তু এই যুক্তিও তর্কের মুখে পড়েছে। প্রশিক্ষণে ঢের টাকা ঢাললে চিকিৎসার মান বাড়ে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশ্বব্যাঙ্কের দুই গবেষক, জিষ্ণু দাশ এবং জেফ্রি হ্যামার, চারটি দেশে (ভারত, ইন্দোনেশিয়া, প্যারাগুয়ে এবং তানজানিয়া) সমীক্ষা করেছেন, রোগীরা বাস্তবিক কেমন চিকিৎসা পাচ্ছেন। খুব সাধারণ কিছু রোগে চিকিৎসার যে বিধি (‘প্রোটোকল’) চালু রয়েছে তার কতগুলো ডাক্তাররা মানছেন, তা দেখা হয়েছে সমীক্ষায়। ভারতে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লক্ষ শিশু মারা যায় ডায়ারিয়াতে। খাস রাজধানী দিল্লিতে দেখা যাচ্ছে, ডায়ারিয়া-আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে মাত্র ২৫ শতাংশ ডাক্তার প্রশ্ন করেছেন শিশুর মলে রক্ত বা আম আছে কি না, ৪৯ শতাংশ জানতে চেয়েছেন জ্বর আছে কি না। শিশুর শরীরে জল কম (ডিহাইড্রেশন) কি না, তা পরখ করেছেন মাত্র সাত শতাংশ। অন্য দেশগুলোতেও ফল উনিশ-বিশ।
এই চিকিৎসকদের মধ্যে কিন্তু সরকারি আর বেসরকারি, ডিগ্রি-পাশ আর হাতুড়ে, সকলেই ছিলেন। পাশ-করা ডাক্তাররা কতটা ভাল চিকিৎসা করছেন হাতুড়েদের চাইতে? সমীক্ষা বলছে, খুব তফাত নেই। “গ্রাম আর শহর, দু’জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে, আবশ্যক প্রশ্ন বা পরীক্ষা, রোগ নির্ণয় বা যথাযথ চিকিৎসা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণহীন ডাক্তারদের মধ্যে তফাত খুব সামান্য। বেসরকারি ব্যবস্থার চাইতে সরকারি ব্যবস্থায় উন্নত চিকিৎসাও দেখা যাচ্ছে না। বরং দেখা যাচ্ছে, হাতুড়েরা প্রশ্ন একটু বেশি করছেন, চিকিৎসাও সরকারি ডাক্তারদের চাইতে খারাপ করছেন না।” এই সমীক্ষার সিদ্ধান্ত, চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ চিকিৎসার উচ্চমানের গ্যারান্টি নয়।
তা হলে ভাল চিকিৎসা, মন্দ চিকিৎসার নির্ণায়ক কী? গবেষকরা দেখছেন, দারিদ্রই সেই নির্ণায়ক। যে সব এলাকায় ধনীরা থাকেন, চিকিৎসা করান, সেখানে সরকারি এবং বেসরকারি, উভয় ক্ষেত্রেই চিকিৎসার মান অনেক ভাল। আর গরিব এলাকাতে সব ধরনের চিকিৎসার মানই খারাপ। ‘ফালতু খরচ’ (‘মানি ফর নাথিং’) শিরোনামে প্রকাশিত এই সমীক্ষা স্পষ্ট করে দিচ্ছে, আরও প্রশিক্ষিত ডাক্তার, আরও বেশি যন্ত্রপাতি দিয়ে চিকিৎসার মান নিশ্চিত করা যাবে না। ডাক্তাররা যা জানেন, তা বাস্তবিক প্রয়োগ করছেন কি না, তা বোঝার, মাপার, উপায় খুঁজে বার করতে হবে।
ডাক্তারদের ‘রিসার্টিফিকেশন’ আবশ্যক করা, আউটডোরে নিয়মিত নজরদারি, প্রেসক্রিপশন অডিট এমন কোনও উদ্যোগ কি নিচ্ছে কাউন্সিল? বহু আলোচনা হয়েছে, কাজ হয়নি। অনেকে বলেন, ডাক্তারদের ‘লবি’ এত শক্তিশালী, যে কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বরাবরই যায় ডাক্তারদের নিরাপত্তার দিকে, রোগীর নিরাপত্তার দিকে নয়।
সাধারণ মানুষের, বিশেষত গরিব মানুষের দৃষ্টিতে যদি দেখা যায়, তা হলে দু’দিক থেকে নিরাপদ চিকিৎসার অঙ্গীকার রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে মেডিক্যাল কাউন্সিলের নীতি।
এক, যথেষ্ট চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, হাজার মানুষে একজন ডাক্তার দরকার, এ দেশে যা এখন ২০০০:১। যোজনা কমিশন দ্বাদশ পরিকল্পনায় বলছে, অন্তত ৫৭টা নতুন মেডিক্যাল কলেজ করতে হবে। সেই সঙ্গে ১০টা এইমস-ধরনের প্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের মধ্যে সাড়ে পাঁচ লক্ষ ডাক্তার তৈরি করতে হবে। কাউন্সিল যে সব শর্ত তৈরি করছে, আর যে ভাবে তার প্রয়োগ করছে, তাতে তা প্রায় অসম্ভব।
দুই, গরিবের অপচিকিৎসা রুখতে যে প্রস্তাবগুলো বারবার উঠে আসছে, যেমন তিন বছরের ডাক্তারি পাঠ্যক্রম, কিংবা নার্সদের কিছু নির্দিষ্ট চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া, মেডিক্যাল কাউন্সিল বরাবর তার বিরোধিতা করে আসছে।
মেডিক্যাল কাউন্সিল মানরক্ষার প্রহরী হতে চায়, কিন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে খড়ের গাদায় কুকুর। প্রায় পাইকারি হারে আসন বাতিল করে ছাত্রদের (বিশেষত নিম্নবিত্ত ছাত্রদের, কারণ প্রচুর সরকারি আসন বাতিল হচ্ছে) ডাক্তারি পড়ার স্বপ্নে বাদ সাধছে। আবার ভাল চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ থেকেও গরিবকে দূরে রাখছে। কাউন্সিলের দুর্নীতি নিয়ে বহু অভিযোগ উঠেছে, এখনও উঠছে। কিন্তু স্বাস্থ্য নীতির সঙ্গে মেডিক্যাল কাউন্সিলের নীতির একটা বড় ফাঁক থেকেই যাচ্ছে, সে কথাটা তেমন করে উঠছে না। সেটা বোধহয় আর এড়িয়ে যাওয়া চলে না।