পশ্চিমবঙ্গের গায়ক ইন্দ্রনীল সেন ঢাকায় বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ভুল ভাবে গাহিতে গিয়া তিরস্কৃত হইয়াছেন। স্বাভাবিক। অজ্ঞতা এবং অপ্রস্তুতি তিরস্কারের যোগ্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কেহ তিরস্কার করে নাই, কিন্তু তাঁহার সমগ্র বাংলাদেশ সফরটিতে অজ্ঞতা এবং অপ্রস্তুতির দীর্ঘ ছায়া প্রকট। একটি দেশের কোনও ক্ষমতাসীন রাজনীতিক অন্য দেশ সফরে গেলে সেই সফরের দীর্ঘ প্রস্তুতি আবশ্যক হয়। কেন সফর, কী তাহার লক্ষ্য, সেই লক্ষ্য পূরণে সফরটির ভূমিকা কী, সফর হইতে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্জনগুলি কী কী, সেই সকলই প্রস্তুতিপর্বে বিচার করিতে হয়। তাহার পরেও ঘটনাচক্রে আকস্মিকতা থাকিতে পারে, বিশেষত শীর্ষস্তরের নেতারা এমন সিদ্ধান্ত লইতে পারেন যাহা ষোলো আনা পূর্বনির্ধারিত ছিল না। কিন্তু সেই আকস্মিকতাও আকাশ হইতে পড়ে না, প্রস্তুতির জমি হইতেই উঠিয়া আসে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে সেই প্রস্তুতির লক্ষণ ছিল না। দেখিয়া শুনিয়া মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি কলিকাতা হইতে ঢাকায় বেড়াইতে গিয়াছেন ও হাসিগল্প করিয়া ইলিশের ডিমভাজা খাইয়া গান শুনিয়া ফেরত আসিয়াছেন। বস্তুত, সফরের জন্য কোনও প্রকার প্রস্তুতি যে প্রয়োজনীয়, সেই জ্ঞানটুকুও তাঁহার ছিল বলিয়া সন্দেহ করিবার কোনও কারণ দেখা যায় নাই। অপ্রস্তুতি পীড়াদায়ক, অজ্ঞতা লজ্জাকর।
দুর্জনে বলিতে পারে, মুখ্যমন্ত্রীর বাংলাদেশ যাত্রার প্রকৃত উদ্দেশ্যটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং গূঢ়: তিনি সে দেশের সরকারকে জামাত-আদি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তত্পরতার মাত্রা কমাইবার অনুরোধ জানাইতে গিয়াছিলেন, কারণ সেই তত্পরতার ফলে সীমান্তের এ পারে তাঁহার দলের অসুবিধা হইতেছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও নাগরিক আশা করিবেন, ইহা দুর্জনের অপপ্রচারমাত্র, এমন কোনও দুষ্টচিন্তা মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁহার সহকর্মী তথা সফরসঙ্গীদের অন্তরের ত্রিসীমানাতেও স্থান পায় নাই। কিন্তু সেই কারণেই আরও বেশি করিয়া প্রশ্ন উঠিবে: এই সফর শেষে তাঁহার হাতে কী রহিল? তিস্তা লইয়া তিনি ‘ভাবিয়া দেখিবেন’, এই পরম দৈববাণীটুকু বাদ দিলে নূতন কথা শূন্য। তিস্তার জল-ভাগ লইয়া তাঁহার ধনুর্ভঙ্গ পণ ছাড়িয়া মুখ্যমন্ত্রী ভাবিয়া দেখিতে প্রস্তুত, এই সংবাদ বাংলাদেশের পক্ষে আশাব্যঞ্জক হইতে পারে, কিন্তু সত্য ইহাই যে, নদীর জলের মোট পরিমাণ বাড়াইবার উপায় নাই, সুতরাং বাংলাদেশের ভাগ বাড়িলে পশ্চিমবঙ্গের কমিবে।
নদীর প্রবাহের নিম্নবর্তী প্রতিবেশীর স্বার্থে উচ্চবর্তীকে নিজের স্বার্থ ছাড়িতে হইতে পারে। কিন্তু একতরফা স্বার্থত্যাগ নয়, প্রয়োজন জলবণ্টনের প্রশ্নটিকে একটি বৃহত্তর বোঝাপড়ার পরিমণ্ডলে দেখা, যাহাতে সামগ্রিক বিচারে দুই তরফেরই উপকার হয়। বাংলাদেশের সহিত পশ্চিমবঙ্গের ভাষা-ভিত্তিক লেনদেন ও যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনা বিস্তর। সাহিত্য, সংগীত, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদি নানা বিষয়েই সেই সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তাহা কাজে লাগাইবার জন্য প্রস্তুতি আবশ্যক, উদ্যোগও। প্রয়োজন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ এবং পরিকাঠামো সৃষ্টিও। যেমন পশ্চিমবঙ্গ হইতে প্রকাশিত বই এবং পত্রপত্রিকার প্রতিলিপি যে ভাবে বাংলাদেশে অবাধে বিক্রীত হয়, তাহাতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি বিপুল। এই ধরনের কারবার বন্ধ করিয়া দুই পক্ষের যৌথ উদ্যোগে বই ও পত্রপত্রিকা প্রকাশের আয়োজন করিলে দুই পক্ষেরই দীর্ঘমেয়াদি উন্নতি হইবে। কিন্তু সে জন্য বাংলাদেশ সরকারকে আইন এবং প্রশাসনের ক্ষেত্রে কঠোর হইতে হইবে। এই ধরনের বন্দোবস্তের কথা মুখ্যমন্ত্রীর ঢাকা সফরে উঠিবার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সে সকল উদ্যোগের জন্য জানিতে হয়, ভাবিতে হয়, খাটিতে হয়। সর্বত্র সর্বক্ষণ জলসা করিবার মানসিকতা লইয়া পরিভ্রমণ করিলে কাজের কাজ হওয়া সম্ভব নহে।