সম্পাদকীয় ১

পিটুলিগোলা

সুরেশ প্রভুর সহিত তাঁহার প্রধানমন্ত্রীর একটি তফাত অতি স্পষ্ট। তিনি পাদপ্রদীপের চড়া আলোয় দাঁড়াইয়া বাক্যজাল বিস্তার করিতে ভালবাসেন না। নরেন্দ্র মোদীর প্রচার-উৎসাহ না-হয় অস্বাভাবিক রকমের প্রবল, কিন্তু সাধারণ ভাবেই এ দেশের নেতা-মন্ত্রীদের আচরণের মাপকাঠিতে রেলমন্ত্রীকে পর্দানশীন বলিলে অত্যুক্তি হয় না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

সুরেশ প্রভুর সহিত তাঁহার প্রধানমন্ত্রীর একটি তফাত অতি স্পষ্ট। তিনি পাদপ্রদীপের চড়া আলোয় দাঁড়াইয়া বাক্যজাল বিস্তার করিতে ভালবাসেন না। নরেন্দ্র মোদীর প্রচার-উৎসাহ না-হয় অস্বাভাবিক রকমের প্রবল, কিন্তু সাধারণ ভাবেই এ দেশের নেতা-মন্ত্রীদের আচরণের মাপকাঠিতে রেলমন্ত্রীকে পর্দানশীন বলিলে অত্যুক্তি হয় না। অনুমান করা যায়, রেল বাজেটের জন্য স্বতন্ত্র বক্তৃতার রীতি তুলিয়া দিবার সিদ্ধান্তে তিনি— মুখে ‘আর রেল বাজেট ভাষণ দিতে পারিব না’ বলিয়া যতই আক্ষেপ করুন— হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিয়াছেন। এহ বাহ্য। এই রীতি-বদল জরুরি ছিল। ১৯২৩-২৪ সালে ভারতের ব্রিটিশ সরকার যখন স্বতন্ত্র রেল বাজেট পেশ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তাহার বাস্তব কারণ ছিল। রেলের সম্পদ, বিনিয়োগ ও আয়ব্যয় তখন সরকারের সামগ্রিক বাজেটের একটি বিরাট অংশ, স্বতন্ত্র বাজেট ছিল সেই গুরুত্বের স্বীকৃতি। রেল এখনও বিপুল, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আয়ব্যয় অনেক বেশি বিপুল। রেলের আনুপাতিক মাহাত্ম্য বহু কাল আগেই বিগত। সড়ক পরিবহণ বা বিমান পরিবহণের মন্ত্রী যদি আলাদা বাজেট পেশ না করেন, রেলমন্ত্রীরও তাহা করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই। অর্থহীন ঐতিহ্যের ঘানি টানিবার দায় হইতে তাঁহাকে মুক্তি দেওয়া হইতেছে, ভাল।

Advertisement

কিন্তু ভয় হয়, নরেন্দ্র মোদী এই সিদ্ধান্তটিকেই আর্থিক সংস্কারের বিরাট পদক্ষেপ বলিয়া ঢাক পিটাইতে শুরু না করেন। আশা করা যায়, তাঁহার রেলমন্ত্রী তাঁহাকে বুঝাইয়া দিয়াছেন, ইহা কোনও সংস্কার নয়, নিছক অভ্যাসের পরিবর্তনমাত্র। সংস্কার অন্য বস্তু। সুরেশ প্রভু হয়তো তাহার মর্ম কিঞ্চিৎ বোঝেন। তিনি রেল মাসুল নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় মৌলিক সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ করিয়াছেন। সেই পথে অনেক দূর যাইতে হইবে। গত বাজেটে স্বতন্ত্র রেল নিয়ন্ত্রক কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করিয়াছিলেন। যদি সেই প্রতিশ্রুতি এ বার পূরণ করেন এবং যদি সেই কমিটিকে যাত্রী-ভাড়া ও মাসুল নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথার্থ স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তবে বলা চলিবে, ভারতীয় রেলে অন্তত সংস্কারের প্রথম পর্ব শুরু হইল।

কিন্তু তাহা প্রথম পর্ব। রেল সংস্কারের প্রকৃত রূপরেখাটি গত বছর এক বিশেষজ্ঞ কমিটি তাহার অন্তর্বর্তী রিপোর্টে বাঁধিয়া দিয়াছিল। তাহার প্রস্তাব ছিল, রেলের কাজ তিনটি ভাগে বিভক্ত করা জরুরি: নীতি নির্ধারণ করিবে রেল মন্ত্রক; ভাড়া, মাসুল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করিবে স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা, দূরসংযোগের ক্ষেত্রে যেমন নিয়ন্ত্রণ করে ‘ট্রাই’; রেলের সমগ্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করিবে একটি কর্পোরেট সংস্থা, অংশত যেমন ভাবে পরিচালিত হয় বিমান পরিবহন। এই সুপারিশ সংগত কারণেই বৈপ্লবিক বলিয়ৈা অভিহিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহার পরে, কোনও বিচিত্র রহস্যে, কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্টে দেখা যায়, বিপ্লবের হাওয়া পড়িয়া গিয়াছে, বিশেষজ্ঞরা মঝ্‌ঝিম পন্থা দেখাইতেছেন। সুরেশ প্রভুর প্রস্তাবিত সংস্কারও বড় জোর সেই পন্থাতেই সীমিত থাকিবে। ইহা আক্ষেপের কথা। কারণ, রেলকে যথার্থ কর্পোরেট আয়োজন হিসাবে পুনর্গঠন না করিলে তাহার সুস্বাস্থ্য এবং উন্নতি সম্ভব নহে। সেই আয়োজনের প্রথম শর্ত, মূল নীতি নির্ধারণ ব্যতীত অন্য সমস্ত ক্ষেত্রে রেলের পরিচালকদের ব্যবসায়িক স্বাধীনতা দিতে হইবে। রেলপথের সম্প্রসারণ হইতে শুরু করিয়া লোকাল ট্রেনের টিকিটের দাম, কোনও বিষয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ চলিবে না। দরিদ্র যাত্রী বা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহনের জন্য ভর্তুকি দিতে চাহিলে সরকার সরাসরি তাহা দিবেন, রেল তাহার দায় বহন করিবে না। ইহাই সংস্কার। মোদীর ভারতে তাহা দূর অস্ত্।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement