প্রবন্ধ

নকশি কাঁথার নোবেল পুরস্কার

কেমন করে মস্তিষ্ক খুঁজে পায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার পথ? কেমন করে এক পা না ফেলেও চোখ বুজে ‘দেখতে’ পাই ফেলে আসা পথ? বহুদিন পরেও পুরনো পাড়ায় ফিরে খুঁজে পাই প্রিয় চায়ের দোকান? উত্তর সন্ধান করে মেডিসিন-এ নোবেল পেলেন তিন মস্তিষ্কবিজ্ঞানী।সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’-এর ছড়ার শেষে অনেক গোলকধাঁধার পরে পথ আবার সেই আমড়াতলার মোড়েই শেষ হয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা গোলকধাঁধার মধ্যে পথ না হারিয়ে পৌঁছতে পারি গন্তব্যস্থলে। স্মৃতির উপর ভরসা করে খুঁজে পাই ঠিক রাস্তা। ঘর থেকে অফিস, স্কুল, কলেজ, বাজার-হাট সারাদিন রাস্তাঘাটে কত যাওয়া আসা। ঠিক কেমন করে আমাদের মস্তিষ্ক খুঁজে পায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার পথ? কেমন করেই বা এক পা না ফেলেও চোখ বুজে ‘দেখতে’ পাই ফেলে আসা পথ? বহুদিন পরেও পুরনো পাড়ায় ফিরে ঠিক খুঁজে পাই প্রিয় চায়ের দোকান? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অসামান্য গবেষণার জন্য এই বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন মস্তিষ্কবিজ্ঞানী— জন ও’কিফ্ এবং মোসার দম্পতি।

Advertisement

সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

নোবেল ২০১৪। জন ও’কিফ্।

ঠিকানা চাও? বলছি শোন আমড়া তলার মোড়ে,

Advertisement

তিন মুখো তিন রাস্তা গেছে তারই একটা ধরে,

চলবে সিধে নাক বরাবর ডানদিকে চোখ রেখে

Advertisement

চলতে চলতে দেখবে শেষে রাস্তা গেছে বেঁকে।

দেখবে সেথায় ডাইনে বাঁয়ে পথ গিয়েছে কত,

তারই ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মত।

সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’-এর ছড়ার শেষে অনেক গোলকধাঁধার পরে পথ আবার সেই আমড়াতলার মোড়েই শেষ হয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা গোলকধাঁধার মধ্যে পথ না হারিয়ে পৌঁছতে পারি গন্তব্যস্থলে। স্মৃতির উপর ভরসা করে খুঁজে পাই ঠিক রাস্তা। ঘর থেকে অফিস, স্কুল, কলেজ, বাজার-হাট সারাদিন রাস্তাঘাটে কত যাওয়া আসা। ঠিক কেমন করে আমাদের মস্তিষ্ক খুঁজে পায় এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার পথ? কেমন করেই বা এক পা না ফেলেও চোখ বুজে ‘দেখতে’ পাই ফেলে আসা পথ? বহুদিন পরেও পুরনো পাড়ায় ফিরে ঠিক খুঁজে পাই প্রিয় চায়ের দোকান? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অসামান্য গবেষণার জন্য এই বছর নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন মস্তিষ্কবিজ্ঞানী— জন ও’কিফ্ এবং মোসার দম্পতি। এ বারের পুরস্কার আর একটা কারণে লক্ষ করার মতো, কারণ এটা এক বৈজ্ঞানিক ঘরানারও স্বীকৃতি। ও’কিফ্ এই ঘরানার পত্তন করেন চার দশকেরও আগে। তার প্রায় তিরিশ বছর পরে নরওয়ে থেকে দুই তরুণ গবেষক মে-ব্রিট্ ও এডভার্ড আসেন জনের গবেষণাগারে কাজ শিখতে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে প্রেম, তার পর বিবাহ। নরওয়ে ফিরে গিয়ে মে-ব্রিট্ ও এডভার্ড মোসার একসঙ্গে নিজেদের গবেষণাগার শুরু করলেন। সেই কাজ তাঁদের গুরুর আবিষ্কারে এক নতুন মাত্রা দেয়। অতএব গুরু-শিষ্য, স্বামী-স্ত্রী মিলে এই নোবেল পুরস্কার।

সুখবরটা শুনে মনটা আনন্দে ভরে উঠল, কারণ জন ও’কিফকেবেশ ভাল চিনি। গত বছর লন্ডনের রয়াল সোসাইটিতে ওঁর সঙ্গে নৈশভোজের সময় চমৎকার আড্ডা জমেছিল। শুনলাম ওঁর ছাত্রজীবনের কথা। অবাক হলাম জেনে যে, নিউ ইয়র্কের কলেজে পড়াশোনা ঠিকমত না করার জন্য মুশকিলে পড়েছিলেন। জীবনে ঠিক কী করবেন তা নিয়ে মনে প্রচুর সংশয় ছিল। কলেজ শেষ করে গেলেন কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে। ম্যাকগিল তখন ছিল নিউরোলজি ও সাইকোলজির মক্কা। শিক্ষণ ও স্মৃতি (লার্নিং অ্যান্ড মেমরি) নিয়ে গবেষণার জন্য প্রচুর নামডাক। ওখানেই জনের বৈজ্ঞানিক জীবনে বদল শুরু হল। তিনি বেছে নিলেন ভীষণ কঠিন চ্যালেঞ্জ: একটি জীবের আচরণের সঙ্গে তার মস্তিষ্কের মধ্যে স্নায়ুকোষ অথবা নিউরন-এর বৈদ্যুতিক সংকেতের সম্পর্ক বোঝাই ছিল তাঁর গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। চলেফিরে বেড়াচ্ছে এমন একটা ইঁদুরের মস্তিষ্কের মধ্যে নিউরন-এর বৈদ্যুতিক বার্তা রেকর্ড করতে চেষ্টা করলেন। মস্তিষ্কের একটি বিশেষ অংশ— যার নাম হিপোক্যাম্পাস, সেখানকার নিউরনদের কথোপকথন রেকর্ড করলেন খুব সূক্ষ্ম ধাতব তার দিয়ে তৈরি ইলেকট্রোড-এর মাধ্যমে। ১৯৭১ সালে প্রকাশ করলেন সাড়া জাগানো গবেষণাপত্র। নানান পরীক্ষীনিরীক্ষা করে ও’ফিক্ দেখলেন যে, একটা ইঁদুরকে খোলা চত্বরে ছেড়ে দিলে সে ঘোরাফেরা করে, চত্বরের নানা কোনায় গিয়ে দেখে কোথায় কী আছে। এক কথায় নতুন পরিবেশ কৌতূহলের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করে। ইঁদুরটি যখন চত্বরের এক জায়গায় পৌঁছয়, তখন হিপোক্যাম্পাস-এর একটা নিউরন খুব জোর বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়। কিন্তু যেই ইঁদুরটি একটু সরে গিয়ে অন্য আর এক জায়গায় পৌঁছল, তখন হিপোক্যাম্পাস-এর অন্য একটি নিউরন ‘ফায়ার’ করল অর্থাৎ জেগে উঠল এবং আগের নিউরন চুপ মেরে গেল। তার পর আবার যেই অবস্থানের বদল হল, সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটি নিউরন জেগে উঠল, আগের দু’টি চুপ। অর্থাৎ, ওই চত্বরটির প্রতিটি অংশের জন্য হিপোক্যাম্পাস-এর এক-একটি নিউরন বরাদ্দ থাকছে। ধরুন, দাবা খেলার বোর্ডে ওই ইঁদুরটি যদি ঘুরে বেড়ায়, তা হলে প্রতিটি ছোট খোপে একটা আলাদা নিউরন ফায়ার করবে, এবং ৬৪টি নিউরন মিলে ওই বোর্ডটার একটা ছবি গড়ে তুলবে। এ বারে কল্পনা করুন যে, প্রতিটি খোপের নিউরন-এর জন্য একটা আলাদা রং দেওয়া হল। তা হলে দাবা বোর্ডের ৩২টি কালো ও ৩২টি সাদা খোপের বদলে দেখা যাবে ৬৪টি আলাদা রঙের এক চিত্তাকর্ষক বোর্ড। ও’কিফ্ হিপোক্যাম্পাস-এর এই আশ্চর্য নিউরনগুলোর নাম দিলেন ‘প্লেস সেল’। ইঁদুরটি যখন তার পরিবেশ ঘুরেফিরে দেখছে, হয়তো বা খাবার খুঁজছে, তখন একাধিক প্লেস সেল একসঙ্গে সেই জায়গাটির একটা ছক তৈরি করে ফেলছে। আর এ ভাবেই তৈরি হচ্ছে সেই জায়গাটির স্মৃতি।

চার দশক ধরে প্রচুর গবেষণা করছেন ও’কিফ্ ও অন্য বৈজ্ঞানিকরা। নানান মজার তথ্য পাওয়া যায় এই সব কাজ থেকে। একটা ঘর কল্পনা করুন, যার বাঁ-দিকের দেয়ালে একটি ছবি ঝুলছে, সামনে সোফা ও ডান দিকে দরজা। কিছু ক্ষণের মধ্যেই প্লেস সেলগুলো ওই ঘরটার একটা ‘ম্যাপ’ এঁকে ফেলবে হিপোক্যাম্পাস-এর ক্যানভাসে। এ বার ঘরটা যদি ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ডান দিকে, তা হলে ওই প্লেস সেল-এর ম্যাপটাও একই ভাবে ঘুরে যাবে। ঘরটাকে যদি বড় করে দেওয়া হয়, কিন্তু আসবাবপত্র একই জায়গায় থাকে, তা হলে প্লেস সেল-এর ছবিটি প্রসারিত হবে। ঘরটা যদি হঠাৎ অন্ধকারে ডুবে যায়? প্লেস সেলগুলো কিন্তু তাদের কাজ ঠিক চালিয়ে যাবে! ‘কালি দিয়ে চুনকাম’ করলেও প্লেস সেল তার পথ হারাবে না। আমার মতো যারা লোডশেডিং-এর জমানায় বড় হয়েছেন, এটা তাদের পক্ষে বিশেষ সুখবর আমাদের ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার নয়। গত দুই দশকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে হিপোক্যাম্পাস-এর নিউরনগুলির মধ্যে নানান জৈব রাসায়নিক বদল ঘটানো সম্ভব হয়ছে, যার ফলে ইঁদুরের স্মৃতিভ্রম হয়। এবং এই সব ভুলোমন ইঁদুরদের হিপোক্যাম্পাস-এর প্লেস সেলগুলির বড়ই দুরবস্থা একদম ‘হয়নি হয়নি ফেল্’। অর্থাৎ, ও’কিফের গবেষণার ফলেই আমরা বুঝলাম কেমন করে হিপোক্যাম্পাস মস্তিষ্কের মধ্যে বিরাজমান সেই ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’।

কিন্তু হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু সখা থাকলেই তো চলে না। হাতে একটা বড় মাপের ম্যাপ থাকলে সুবিধা হয়। ম্যাপ দেখে একটা জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার জন্য একটা ‘কোঅর্ডিনেট সিস্টেম’ থাকে এক ধরনের কাঠামো, যেখানে অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার সাহায্যে জানা যায় বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যতের গন্তব্যস্থান। মানচিত্র ছোট ছোট গ্রিড-এ ভাগ করা থাকে। ২০০৫ সালে মে-ব্রিট ও এডভার্ড মোসার এমনই একটা গ্রিড-এর মতো ছক আবিষ্কার করেন হিপোক্যাম্পাস-এর প্রতিবেশী অঞ্চলে, যার নাম ‘এন্টরিনাল কর্টেক্স’। ও’কিফের মতোই মোসাররা কর্টেক্স-এর ভিতরে অনেকগুলি সরু তার ঢুকিয়ে রেকর্ডিং করলেন সেখানকার নিউরনগুলির বার্তা। দেখা গেল, সেখানে অনেকগুলি নিউরন একসঙ্গে ফায়ার করছে। আশ্চর্য ভাবে ওই সেলগুলি পরিপাটি ভাবে একটা জ্যামিতিক ছকের আকারে সাজানো। মোসাররা এই ছকে বাঁধা সেলগুলোর নাম দিলেন গ্রিড সেল। কর্টেক্স-এর এই অঞ্চলে একটার পর একটা গ্রিড পাশাপাশি সাজানো থাকে একই ছকে। অতএব, এই গ্রিড সেলগুলি একসঙ্গে মিলে মস্তিষ্কের ভিতরে বোনে এক অন্যবদ্য নকশি কাঁথা। এবং সেই নকশি কাঁথার মাঠে যখন যেখানে অবস্থান, সেইখানে হিপোক্যাম্পাস-এর প্লেস সেলগুলি সেই জায়গার জানান দেয় তাদের বৈদ্যুতিক বার্তার মাধ্যমে।

কোথায় ছিলাম, কোথায় আছি এবং কোথায় যাব এই নিয়েই তো আমাদের জীবন, তাই না? আর আমাদের মস্তিষ্কের গভীরে একদল নিউরন এই গুরুদায়িত্ব বহন করছে প্রতি মুহূর্তে। এই কারণেই এ বারের ফিজিয়োলজি/মেডিসিন-এর নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক দার্শনিক মাত্রাও।

বেঙ্গালুরুতে ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিকাল সায়েন্সেস-এ সেন্টার ফর ব্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিপেয়ার-এর অধিকর্তা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement