রাজনৈতিক তরজার অপেক্ষা স্বাভাবিক বস্তু মনুষ্যসভ্যতায় বেশি নাই। যেখানেই কতিপয় মানুষের জটলা, সেখানেই নিশ্চিত তরজা। কিন্তু তরজারও তো বিবিধ প্রেক্ষিত, উৎস ও গতিমুখ থাকে, যাহার উপর নির্ভর করিয়া প্রাসঙ্গিকতার হেরফের ঘটে। গণতন্ত্র-ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন নেতার নেতৃত্ব বিষয়ে লিখিত কোনও তথ্যভিত্তিক বই লইয়া যখন চাপান-উতোর শুরু হয়, তাহাকে বলা যাইতে পারে অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর তরজা, গণতন্ত্রের মান-বর্ধক বিতর্ক। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ ও তাঁহার উপর তাঁহার দল-নেত্রী সনিয়া গাঁধীর নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে হাজার কথা ২০০৯ সালে দ্বিতীয় ইউ পি এ সরকার আসীন হইবার আগে হইতেই চালু। কোনও সিদ্ধান্তই যে প্রধানমন্ত্রী নিজ দায়িত্বে লইতে পারেন না, নেত্রীর অঙ্গুলিনির্দেশেই যে তাঁহাকে ওঠা-বসা করিতে হয়, এ-সকল অভিযোগ কেবল বিরোধী বৃত্তে সীমাবদ্ধ থাকে নাই, গণ-আলোচনা পরিসরেও শোনা গিয়াছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারুর বইটি লইয়া যে উত্তপ্ত আলোচনা, তাহা যেন ভারতীয় রাজনৈতিক বিতর্কের প্রেক্ষিতটিকে এক ধাক্কায় বয়ঃপ্রাপ্ত করিয়া দিল। প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব দফতরের তাকে সুরক্ষিত ধুলাবৃত ফাইলগুলি নূতন করিয়া প্রাসঙ্গিক হইয়া উঠিল। বারুর বক্তব্য বিতর্কিত ও প্রশ্নযোগ্য হইতেই পারে। কিন্তু সেই বিতর্ক চালনার্থে প্রতিপক্ষকেও এ বার ফাইল-সম্ভারের আশ্রয় লইতে হইবে। রাজনৈতিক মহলের বিবিধ-গামী কথা-কাহিনির মোকাবিলার জন্য রাজনীতির হালচাল বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ হইতে হইবে।
বইটিকে এই কারণেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ, এমনকী পথ-প্রদর্শক বলা চলে। ভারতে কোনও কালেই সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনাবলি লইয়া প্রত্যক্ষ তথ্যভিত্তিক পুস্তক প্রণয়নের রেওয়াজ নাই। সেই মৌর্য যুগেও গ্রিক ভবঘুরে মেগাস্থিনিস আসিয়াছিলেন বলিয়া বাঁচোয়া। গুপ্ত সাম্রাজ্যে চিনা ভাগ্যসন্ধানী ফা হিয়েন-এর পা পড়ায় সৌভাগ্যক্রমে তাঁহার বিবরণে দিনকালের কিছু ইঙ্গিত মিলিয়াছিল। একটি কথা ঠিক, রাজকার্য বিষয়ক প্রত্যক্ষ তথ্য বিতর্ক তৈরি করিতে বাধ্য, রাজরোষ নিশ্চিত করিতেও। সেই কারণেই কি এই অনীহা? কারণ যাহাই হউক, ভারতের ক্ষেত্রে সমসময়ের এই অহৈতুকী অমনোযোগ যে ক্রমে বিগত-সময়ের রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও একটি বড় বাধা হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। পশ্চিমের দেশগুলিতে নেতা, সচিব অথবা উপদেষ্টারা যে তাঁহাদের অবস্থানগত সুবিধা কাজে লাগাইয়া রাজনীতির অন্দরের কাহিনি লিপিবদ্ধ করিতে কোনও কালে দ্বিধা করেন না, তাহা সমসময়ে যতই বিতর্ক-উৎপাদক হউক, পরবর্তী ইতিহাস-সংকলকদের জন্য বিশেষ জরুরি।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর ইতিমধ্যেই প্রবল বিরক্তি ও আপত্তি জানাইয়াছে। বইটিতে প্রধানমন্ত্রীর অক্রিয়তার যে ছবি উদ্ভাসিত, তাহার পশ্চাতে বিজেপি-র অনুপ্রেরণা খুঁজিতেছে। সেই সন্ধানের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিষেধক হিসাবে ২০০২-পরবর্তী পর্যায়ে নরেন্দ্র মোদী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর চিঠিপত্র প্রকাশের তোড়জোড়ও চলিতেছে, কেননা তাহাতে মোদীর প্রতি বাজপেয়ীজির যে ভর্ৎসনা, গুজরাতের দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকার উপর তাহা কিছু আলোকপাত করে। এই ঢিলের বদলে পাটকেল প্রতিক্রিয়া যতই ছেলেমানুষি হউক, রাজনীতি-ক্ষেত্রে অভাবিত নহে। অবাঞ্ছিতও নহে। সরকারি নথিসাবুদ, চিঠিপত্রের ভিত্তিতে দাবি ও প্রতিদাবির এই লড়াই সরকারি নেতাদের মধ্যেও স্বচ্ছতা ও সঙ্গতি বাড়ায়, বৃহত্তর সমাজকেও তথ্য-সমৃদ্ধ ও বিবেচক করিয়া তোলে। পরস্পরের দিকে আঙুল উঁচাইয়া গালি, হুমকি কিংবা প্রতিহিংসা-বচনের অপেক্ষা ইহা অনেক স্বস্তিকর রাজনীতি-চর্যা। দেরিতে হইলেও ভারত তেমন একটি দৃষ্টান্ত দেখিতেছে।