পদবিতে ‘সিংহ’টা শুধু-শুধু নেই রে ভাই, মুভি কোম্পানির লোগোর মতো কেশর ঝাঁকিয়ে ইয়া ডেসিবেল গর্জন ছাড়ছে! আমার দল বদলায়, ভাও বদলায় না! ওয়ার্ল্ড কাপ থেকে বাদ দিলি তো? দেখ, ষোলো কোটিতে কিনল দিল্লি ডেয়ারডেভিলস! আগের বার চোদ্দো কোটিতে কিনেছিল বেঙ্গালুরু! পরের বার আঠেরো বা বিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হয়তো মুম্বই, কি কলকাতা, বা সব্বাই। উচ্চকোটির খেলোয়াড় রে বাবা! যেমন মাচো দেখতে, রাজার মতো ঠাট, তেমনই গদার মতো ব্যাট হাঁকড়ানো! এই ঢাই কিলো কা কাষ্ঠ এক বার ধড়াম লাগালে কোথায় স্পিন কোথায় ফাস্টো! গ্যালারির লোকে হেলমেট পরে নেয় রে, আমি ক্রিজে এলে। আর ট্র্যাক রেকর্ড? বাপ! বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্য সিরিজ। তার আগে টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপে? এক ওভারে ছ’টা ছক্কা! এ সব ক্রিকেট বইয়ের প্রাচীন চ্যাপটারে পড়া যায়— আবছা কালো ছবিতে ডন ব্র্যাডম্যান কি ভিক্টর ট্রাম্পার অলৌকিক সব স্ট্যাটিস্টিক্স আর মিথের জম্ম দিচ্ছেন— কিন্তু চর্মচক্ষে, মানে লাইভ টিভিতে, দেখতে পায় কেউ? আমি ছিলাম বলে তোরা হিস্ট্রিতে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে পারলি। আমি ছিলাম বলে অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপে নাকের জলে চোখের জলে করতে পারলি। তার পরের বিশ্বকাপে আমায় ছেঁটে দিলি! কৃতজ্ঞতার কথা ছেড়েই দিলাম, একটা ইতিহাসের সেন্স নেই?
আর মেয়েগুলো কী মীরজাফর! আগে একেবারে সেলোটেপের মতো চিপকে থাকত, হুমড়ি খেয়ে ল্যাং পাকিয়ে আমার পানে হান্ড্রেড মিটার দৌড়ত, তাপ্পর যেই শুনল ক্যানসার, হোলসেল ভোঁ-ভাঁ! পাবলিকেরও কী গ্রাম্ভারি নিদান! এ আর কোনও দিন ব্যাট আছড়াতে পারবে না, একটা ইন্টারন্যাশনাল মাঠের বাউন্ডারি পার করতে যে দম লাগে তা ওর লাংস নিতে পারবে ক্যায়সে, ফিল্ডিংটার দফারফা, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস তো ওয়াকিং হয়ে যাবে রে হিহি। বাসে ট্রামে এক্সপার্টরা কষে মাথা নাড়াতে লাগল। চুকচুক করে আকাশের দিকেও একটু তাকিয়ে নিল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কেমো নিয়েছি আর ভেবেছি, দাঁড়া ব্যাটা, এখন লংকার ছিটে দিচ্ছিস তো, অ্যায়সা ছক্কা মারব না, বলটা তোর হাঁ-মুখে স্ট্রেট সেঁধিয়ে গপ! কী কামব্যাক দিলাম! হ্যাঁ, পাজির পাঝাড়ারা তবু টোন কেটেছে: আমাকে টিমে ফেরত নেওয়া হল মেলোড্রামার খাজনা দিতে। সিমপ্যাথির ঢেউয়ে চড়ে আমি ‘রিটার্ন অব দ্য রোগী’ পোস্টার সাঁটছি, সবাই গরম অশ্রুতে হেডলাইন ভেজে খাচ্ছে। সে অশ্লীল টিটকিরির ছ্যাঁকাও সয়েছি। তার পর খেলেছি। হ্যঁা, এক এক দিন মানুষের অফ ফর্ম যেতেই পারে। একটা ফাইনালে ঝুলিয়েছি, ব্যস, লেবেল পড়ে গেল, দি এন্ড, কর্কট-দাঁড়া আমায় ছিবড়ে করেছে। এ তো যৌন স্ক্যান্ডালের বাড়া হইল! হাঁচলে কাশলে ফুলটসে বিট হলে সারা ক্ষণ অসুখটার নামের গুঁতো খেতে হবে? কেন রে, বাকিরা মাঠে নেমে ধেড়িয়ে ফাঁক করছে, তখন তো তার শৈশবের ডিপথিরিয়া নিয়ে টান মারছিস না! ভাই, গালাগাল দে, কিন্তু ক্রিকেটের টার্ম ব্যবহার কর, মেডিকাল জার্নাল দেখাস না!
অবশ্য ক্রিকেট যারা বুঝে উলটে যাচ্ছে, তারা যা টিম করল! গম্ভীর, আমি, সহবাগ, ভাজ্জি বাদ! এখানে ব্যাট-বলের ব্যাপারটাকে সেন্টারে ধরছেন তো দাদারা? না কি, কেউ খার মিটিয়ে নিচ্ছে? ড্রেসিং রুমের ঝগড়া উসুল করছে? বিশ্বকাপে তিরিশ জনের লিস্টি ঘোষণা করা হল, আমি নেই। তখন কী করলাম? রঞ্জিতে তিনটে ম্যাচে পর পর সেঞ্চুরি! হরিয়ানার সঙ্গে ১৩০, মহারাষ্ট্রের সঙ্গে ১৩৬, সৌরাষ্ট্রর সঙ্গে ১৮২! তাতে কী এল-গেল? আমায় কি লাস্ট সিনে স্লো মোশনে হাত বাড়িয়ে রানিং প্লেনে তুলে নেওয়া হল? উঁহু, এটা ডিডিএলজে নয়, ইন্ডিয়ার ক্রিকেট ঘোটালা। এখানে দুষ্টের রমণ, শিষ্টের অবনমন। অন্যরা মাঠে খেলছে, আমি বসে বসে টুইটারে ১৪১ ক্যারেক্টারের মধ্যে মত দিচ্ছি। যেই রেকর্ড টাকায় আইপিএলে আমায় কেনা হল, ইউফোরিয়ার চোটে আমার বুড়ো বাপের মুখ দিয়ে ফটাস অভিমান ছিটকে বেরোল: ‘আমার ছেলের সঙ্গে ধোনির যদি ব্যক্তিগত ঝামেলা থাকে, আমি কিছু করব না, ভগবানই বিচার করবেন।’ শুনে আমার মাথায় হাত! তড়িঘড়ি ম্যানেজ দিয়ে লিখলাম, বাপ-মা সব সময়ই একটু বেশি আবেগওলা হয়... আমার ধোনির আন্ডারে খেলতে দারুণ লাগবে... কিন্তু ঝুলি থেকে বেড়াল যখন তিড়িং লাফে বেরোয়, তার নখে পাপোশের রোঁয়া উড়বেই। আমার তো বাবাকে গিয়ে গলা টিপে দিতে ইচ্ছে করছে, যা-ও বা চান্স ছিল, এ বার আর ধোনি আমায় টিমে ফেরত আসতে দেবে বলে মনে হয় না। আরে, বাড়িতে ডেলি শাপান্ত করছি ঠিক আছে, এ জিনিস কখনও অফিশিয়ালি চেল্লানো যায়? এক যদি টিমটা ওয়ার্ল্ড কাপে গো-হার হারে, ওই টাইট হালুয়ার ওপর আবার আমার নামটা নখ-টখ দিয়ে খোদাই করা যাবে। কিন্তু নিজের দেশের পরাজয়-কামনার কথা এক বার শোওয়ার ঘরের বাইরে বেরিয়েছে কি ১২৫ কোটি বাটাম! ক্রিকেট তো এ দেশে সবচেয়ে স্পর্শকাতর ধর্ম!
কিন্তু ধর্মের কল আনতাবড়ি নড়ছে কেন? ধোনির কি মনে নেই, বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন আমি হঠাত্ অসুস্থ হলাম বলেই আমার জায়গায় ও নামল, আর ওস্তাদি করে ছয় মেরে ব্যাট ঘুরিয়ে পোজ দিতে পারল! বাকি টুর্নামেন্টটা তো স্রেফ ইন্টারভিউ দিয়েছে! আমার যদি সে দিন না বমি পেত, ওই ব্যাট ঘোরায় কে? কে-ই বা ‘নন-প্লেয়িং’ ক্যাপ্টেনের ছাপ্পা পায়? আসলে, মানুষের ঋণ-মেমোরি খুব কম। আবার, হীন-মেমোরি খুব বেশি। কবে হয়তো কোন লম্বা-পা ফিল্মসুন্দরীকে নিয়ে এট্টু টাগ-অব-ওয়ার হয়েছিল, সেই চচ্চড়িতে এখনও রিভেঞ্জ-ফোড়ন ছাড়ছে। আনস্পোর্টিং! সত্যিকারের ‘হেলিকপ্টার শট’ দেখতাম, যদি আজ খেলার আগে কপ্টারে করে আমায় মাঠে নামিয়ে নিত!
লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়