আজ রাষ্ট্রীয় একতা দিবস। বল্লভভাই পটেলের জন্মদিনটি ইন্দিরা গাঁধীর মৃত্যুদিনের ছটায় ঢাকা পড়িয়া গিয়াছিল, নরেন্দ্র মোদী তাহাকে পুনরুদ্ধার করিতেছেন। সবরমতীর তীরে ‘একতার মূর্তি’-র উচ্চতা যদি পটেলের প্রতি মোদীর ‘শ্রদ্ধা’-র সমানুপাতিক হয়, তবে তাহা অগ্রাহ্য করিবার বিষয় নহে। পরিবারতন্ত্রের মোহে কংগ্রেস পটেলকে ফেলিয়া দিয়াছিল, মোদী তাঁহাকে কুড়াইয়া লইয়াছেন। মোদীর ভাঁড়ারে ‘আইকন’-এর অভাব বড়ই তীব্র— সভরকর হইতে হে়ডগেওয়াড় বা গোলওয়ালকর, ভারতে বহমান তীব্র হিন্দুত্ববাদী হাওয়াতেও এই মহামানবদের কাহাকে ‘জাতীয় নায়ক’-এর সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করা মুশকিল। নাগপুরের নিকট নহে, সাধারণ মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্য ‘জাতীয় নায়ক’ খুঁজিতে হইলে তাহা কংগ্রেসের ইতিহাসেই খুঁজিতে হইবে। নরেন্দ্র মোদী বল্লভভাই পটেলকে বাছিয়া লইয়াছেন। কেন পটেল, কেন অন্য কোনও নেতা নহেন, এই প্রশ্নের প্রথম উত্তর হইল, ইতিহাসের অশিক্ষিত পাঠ বলিবে, পটেল ছিলেন নেহরুর প্রতিদ্বন্দ্বী। অশিক্ষিততর পাঠ বলিবে, পটেলকে বঞ্চিত করিয়াই নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হইয়া বসিয়াছিলেন। কিন্তু ইহাই সম্ভবত একমাত্র কারণ নহে। দেশভাগের সময়ে পটেলের অবস্থানে নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত হিন্দুত্বের গন্ধ খুঁজিয়া পান। তাঁহারা মনে করাইয়া দেন যে নেহরু যখন মুসলমানদের বিশেষ দৃষ্টিতে দেখিবার কথা বলিয়াছিলেন, পটেল সেই প্রত্যক্ষ বিরোধী ছিলেন। সচেতন ভাবেই ভুলিয়া যান, গাঁধী-হত্যার পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করিবার সিদ্ধান্তটিও পটেলেরই ছিল।
কংগ্রেসে হিন্দুত্ববাদী নেতা একা পটেল ছিলেন না। বস্তুত, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, মদনমোহন মালব্য বা রাজেন্দ্র প্রসাদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদের সুবাস আরও অনেক বেশি প্রকট। তাহা হইলে মোদী অন্যদের ফেলিয়া পটেলকেই লইলেন কেন? উভয়েই প্রাদেশিক পরিচয়ে গুজরাতি, এই মিলটুকুই এই চয়নের একমাত্র কারণ নহে। কংগ্রেসের কল্যাণে বিস্মৃতপ্রায় পটেলকে ভারত যেটুকু মনে রাখিয়াছে, তাহা ‘লৌহমানব’-এর পরিচয়ে। ঘোর ‘পুরুষ’ এক নেতা, যিনি দেশের ঐক্যবিধানের প্রশ্নে দুর্দমনীয় ছিলেন। পটেলের যে অনুষঙ্গগুলি জাতীয়-স্মতিতে টিকিয়া আছে, সেগুলি পৌরুষের অভিজ্ঞান— বলিষ্ঠতা, প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা, নিজের ইচ্ছা প্রতিষ্ঠা করিবার সামর্থ্য ইত্যাদি। অর্থাৎ, পটেল সেই ‘পুরুষ’, নরেন্দ্র মোদী নিজেকে যে ‘পুরুষ’ হিসাবে দেখাইতে চাহেন। পটেল নিজে তেমন ছিলেন কি না, নরেন্দ্র মোদীর নিকট সেই প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক। তাঁহার চরিত্রের অন্য সব দিকে ছাঁটিয়া তাঁহাকে একটি ‘সামরিক-রাষ্ট্রের’ উপাস্য মূর্তিতে পরিণত করাই এই প্রচারের লক্ষ্য। সেই দেবতার অবতার কে হইবেন, দেবতার জন্মের পূর্বেই তাহা স্থির হইয়া গিয়াছে।
নরেন্দ্র মোদী তাঁহার স্বচ্ছ ভারত অভিযান-এর সূচনার জন্য ২ অক্টোবরকেই বাছিয়া লন, তিনি চরকার সম্মুখে বসিয়া ছবিও তোলান। কিন্তু যে ভঙ্গিতে পটেলকে আত্মসাৎ করা সম্ভব, প্রবীণতর গুজরাতিকে সেই ছকে দখল করিয়া লওয়া যায় না। কথাটি সম্ভবত স্বয়ং মোদীও জানেন। কারণ, তিনি নিজে যে যে ধারণার প্রতিনিধিত্ব করেন, গাঁধীর অবস্থান তাহার প্রতিটির বিপ্রতীপ। মোদী যে ‘পৌরুষ’-এর পূজারি, গাঁধী সেই অর্থে ছিলেন ‘নারী’— বাপু হইলেও মা। মুসলমানদের প্রতি, দলিতদের প্রতি, সর্বোপরি ‘শত্রু’র প্রতি গাঁধী যে অবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন, মোদীর রাজনীতি তাহার ছায়াও মা়ড়ায় না। এই অসম্ভাব্যতার কারণেই মোদী গাঁধীর চশমা লন, চরকা লন। বাহ্যিক গাঁধীকে আত্মসাৎ করা চলে। কিন্তু তাঁহার আত্মা, তাঁহার বিশ্বাস মোদীদের নাগালের বাহিরে। অতএব, পটেলই ভরসা।