ইরানে মহিলারা খেলাধুলা করিলে কেবল মহিলারাই তাহা দেখিতে পারেন। খেলোয়াড়দেরও সকলকে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত থাকিতে হয়। একই অবস্থা আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও। ক্রীড়াঙ্গনে পুরুষদের খেলা দেখিতে যাওয়ার নিয়মও সেখানে নাই। নিয়ম ভাঙিলে হাজতবাসই ন্যূনতম সাজা। আর সৌদি আরব তো মেয়েদের খেলাধুলাকেই শাস্ত্রবিরোধী মনে করে। এই দেশগুলিতে সব কয়টি দেশেই কট্টরপন্থী ইসলামি শাসনের জয়জয়কার। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। এই রাজ্যের মালদহ জেলার একটি গ্রামে মহিলাদের একটি ফুটবল ম্যাচ বন্ধ করিয়া দিতে হইল মৌলবিদের আপত্তিতে। আপত্তির কারণ: আঁটোসাঁটো পোশাক পরিয়া মহিলাদের
খেলিতে নামা নাকি ধর্মীয় অনুশাসনের বিরোধী। লক্ষণীয়, মৌলবিদের সহিত যিনি বিডিও-র কাছে ওই খেলা বন্ধ করার আর্জি লইয়া গিয়াছিলেন, তিনি রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা। অতঃপর পুলিশ খেলাটি মাঝপথে বন্ধ করিয়া দেয়।
মালদহের এই ঘটনা সম্পর্কে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এক মহিলা ফুটবল খেলোয়াড় প্রশ্ন তুলিয়াছেন: যিনি নিজের ইচ্ছায় ফুটবল খেলিতে চাহেন, ধর্মের নামে অন্যরা কেন তাঁহার ইচ্ছাপূরণে হস্তক্ষেপ করিবে? এই প্রশ্নের সহজ এবং স্পষ্ট উত্তর: ইহাই মৌলবাদী মানসিকতার চরিত্রলক্ষণ। সেই মানসিকতার ধ্বজাধারীরা চিরকালই ধর্মের নামে, শাস্ত্রের নামে ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করিতে তত্পর হইয়াছে। কোন ধর্মগ্রন্থে বা লোকবিধিতে কী নিষিদ্ধ, তাহার চুলচেরা বিচার করিয়া এই তত্পরতার মোকাবিলা করিতে অনেকেই যত্নবান হইয়া থাকেন। শাস্ত্রের সাহায্যে শাস্ত্রের অনুশাসন খণ্ডনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আছে বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহের পক্ষে এই পথেই সওয়াল করিয়াছিলেন। সেই ধরনের প্রচেষ্টার আজও মূল্য থাকিতে পারে। শাস্ত্রের ‘যথাযথ’ ব্যাখ্যা লইয়া বিতর্ক সুস্থ সমাজের লক্ষণ। কিন্তু উদার গণতান্ত্রিক একটি দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতার স্থান শাস্ত্রবচনের ঊর্ধ্বে। শাস্ত্রে যাহাই বলা থাকুক, তাহার দোহাই পাড়িয়া সেই স্বাধীনতা খর্ব করা চলে না। এই মৌলিক শর্তটি যাহাতে পূর্ণ হয়, তাহা নিশ্চিত করা প্রশাসনের দায়িত্ব। বস্তুত, এই স্বাধীনতা খর্ব করিলে তাহা সরাসরি অপরাধের শামিল। ধর্ম বা লোকবিধির নামে অপরাধের বিচার নিয়ন্ত্রিত হইতে পারে না। যে কারণে ভারতীয় ফৌজদারি আইন সমস্ত নাগরিকের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য, সেই কারে ণই ফুটবল ম্যাচ জোর করিয়া বন্ধ করিলে তাহার বিচারেও ধর্মীয় অনুশাসনের প্রশ্ন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। ইহা অপরাধ, সুতরাং দণ্ডনীয়।
মালদহের ঘটনায় প্রশাসনের মৌলিক দায়িত্ব সম্পূর্ণ লঙ্ঘিত হইয়াছে। অন্যায় চাপ প্রতিহত করিয়া খেলা চালু রাখার পরিবর্তে প্রশাসনের কর্তারা খেলা বন্ধ করিতেই তত্পর হইয়াছেন। পরে সমালোচনার চাপে পড়িয়া তাঁহারা নানা ছেঁদো যুক্তি সাজাইয়াছেন, তাহাতে মাছ ঢাকা যায় নাই। এই ঘটনা বিশেষ উদ্বেগের কারণ। এই রাজ্যে ধর্মীয় বা সামাজিক গোঁড়ামির দাপট ভারতের অন্য অনেক অঞ্চলের তুলনায় কম বলিয়াই পরিচিত ছিল। কিন্তু উত্তরোত্তর সেই উদার সামাজিক পরিবেশটি ক্ষুণ্ণ হইতেছে। তাহা ভয়ের কথা। আরও ভয়ের কথা, ধর্মগোষ্ঠী এবং রাজনীতির জটিল টানাপড়েনের ফলে এই অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্রমশই দুর্বল হইতেছে। প্রশাসন এবং সমাজ, দুইই সংকীর্ণ রাজনীতির বশীভূত, ফলে ‘আঁটোসাঁটো পোশাক পরিয়া ফুটবল খেলা চলিবে না’ হুকুম জারি হইলে সমাজ এবং প্রশাসন, উভয়েই তাহা নতমস্তকে মানিয়া লয়, পাছে ভোটের অঙ্ক নড়িয়া যায়। তমসা ক্রমশ ঘোরতর।