রাজনৈতিক গুরুত্ব? লোকসভা নির্বাচন, ডিব্রুগড়। ৭ এপ্রিল ২০১৪। ছবি: এএফপি।
ভারতের মেয়েরা নির্বাচনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ১৯৬২ থেকে ২০১২ সালের ভোটদানের পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, যেখানে ১৯৬০-এর দশকে প্রতি ১০০০ পুরুষ ভোটদাতাপিছু ৭১৩ জন মেয়ে ভোট দিতেন, এখন তা হয়েছে হাজারে ৮৮৩। এমনকী পিছিয়ে পড়া বলে কুখ্যাত ‘বিমারু’ (বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ) রাজ্যগুলিতেও সেই হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। ভোটদাতা হিসেবে সংখ্যায় মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন বলে কি রাজনীতির পরিসরে তাঁরা পৃথক গুরুত্ব পাচ্ছেন? মেয়েদের বিষয়গুলি কি এখন ‘সবার’ বিষয় হয়ে উঠতে পেরেছে? তা হলে এখনও কেন জনপ্রতিনিধি হয়ে নির্বাচনে জিতে আসা মেয়েরা সীমাবদ্ধ নারী ও শিশুকল্যাণ, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা— বড়জোর তথ্য ও সংস্কৃতির মতো দফতর নিয়ে? এখনও তাঁদের কপালে ছেঁড়েনি প্রতিরক্ষা, বিদেশ, অর্থ, অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, স্বরাষ্ট্র দফতর— নিদেনপক্ষে অর্থ বা শিল্পের মতো দফতরের শিকেও। আমাদের ষাট বছুরে গণতন্ত্রে এই প্রবণতা চলে এলেও বাংলাদেশে হাসিনার নবীন গণতন্ত্রে কিন্তু বিদেশ, অর্থ, এ রকম দফতর আলো করে ছিলেন মেয়েরাই।
২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিল্লি গণধর্ষণের ঘটনার পর আমাদের বহু আলোচনা আর পুরনো খাতে বইছে না। মেয়েদের নিরাপত্তা হয়ে উঠেছে এমন একটি বিষয়, যেটিকে আর শুধু ‘মেয়েদের’, ‘সামাজিক’, এ সব তকমা লাগিয়ে এক পাশে ফেলে রাখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলিও মেয়েদের জন্য সুরক্ষা, সমতা এ সবের দাবির বাইরে গিয়ে নির্দিষ্ট করে বলতে বাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন ও কেজরীবালের বিস্ময়-উত্থান, নির্ভয়া কাণ্ডের সময় বক্তৃতা দিতে দিতে কেজরীবালের পুলিশি হ্যাঁচকায় ভ্যানে ওঠা— এ সব কিছু মিলিয়ে অন্য রাজনীতিকদেরও বাধ্য করেছে মেয়েদের বিষয় নিয়ে একটু অন্য ভাবে, একটু সার্বিক ভাবে ভাবতে। আর, মেয়েদের উৎসাহিত করেছে নিজেদের ভাবনা নিয়ে এগিয়ে আসতে।
দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় রাজধানীর বেশ কয়েকটি নারী সংগঠন ও ব্যক্তি মেয়েদের ইস্তেহার বলে ছ’দফা দাবিপত্র পেশ করলেন আম আদমি পার্টি, কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টি এই তিন যুযুধান পক্ষের কাছে। শুধুমাত্র আপ এই দাবিগুলির সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে, বাকিরা নীরব ছিল। কী ছিল সেই ছ’দফা দাবি? খুব পরিচিত ও প্রত্যাশিত কয়েকটিই: সবার জন্য শিক্ষা, আইনের রূপায়ণ, দায়িত্বশীল পুলিশ, দক্ষ ও দ্রুত বিচার, নিগৃহীতার সহায়তা, নিরাপদ পথ ও শহর। না মানলে কি ‘নোটা’র বোতাম টেপা? সেটা অবশ্য পরিষ্কার করা হয়নি। কেজরীবাল ও তাঁর মন্ত্রীরা হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতকে ‘প্রয়োজনীয়’ সামাজিক সংগঠন বলে সার্টিফিকেট দিয়ে, কৃষ্ণাঙ্গিনীদের তল্লাশির দাবি করে ইতিমধ্যেই প্রশ্নের মুখে। তাঁর সরকার টিকলে ওই ইস্তেহারের কতটা মানতেন, সেটা জানার সুযোগ আর আগ্রহীদের হল না।
কিন্তু এই প্রয়াস মেয়েদের উৎসাহ দিল লোকসভা ভোটেও এক দাবিপত্র পেশ করার। দিল্লি বিধানসভা ভোটের ইস্তেহার মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করল। সুরক্ষার বাইরে তার সঙ্গে যোগ হল মেয়েদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক গুরুত্বের প্রশ্নটিও। লোকসভায় সংরক্ষণ বিলে সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রশ্নটিও এল। মেয়েদের বিরুদ্ধে হিংসায় কী ভূমিকা, নারীবিরোধী মনোভাব বা মন্তব্যের পরম্পরা, এ সব কিছুকে নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধিতে অন্তর্ভুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে কাজের অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, সমান মজুরি, ১০০ দিনের কাজে আরও সুযোগ, বয়স্ক ভাতা— এ সবের মধ্য দিয়ে আর্থিক সুরক্ষার প্রশ্নটিকেও সামনে নিয়ে আসা হল।
এই লোকসভা নির্বাচনেই দিল্লির আটটি নারী-সংগঠনের ইস্তেহার বেরিয়েছে, যার মধ্যে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি (যাঁদের একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক পরিচয় আছে) থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সভানেত্রী মোহিনী গিরির স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গিল্ড অব সার্ভিসও রয়েছে। এঁরা মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার, সম্পদ ও সম্পত্তির ওপর অধিকার, খাদ্য সুরক্ষা, কাজের অধিকার আর সুযোগ— এ সবকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জনসমক্ষে নারীবিরোধী মন্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া, অনেকগুলি আইন রূপায়ণ ও অন্য অনেকগুলির সংশোধনী এবং অবশ্যই সংরক্ষণ বিল বাস্তবায়নের দাবি তুলেছেন। দুটি ইস্তেহারই রাজ্য ও কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনকে স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে কাজ করতে দেওয়ার জন্য জোর সওয়াল করেছে। এ রাজ্যে সিঙ্গুরের ঘটনার পর ইচ্ছুক জমিদাতা মেয়েদের উপরে আক্রমণে রাজ্যের নারী কমিশন তদন্ত করেছিল, আশ্চর্য ভাবে নীরব ছিল নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়ে’র পর্বে সংগঠিত গণধর্ষণ নিয়ে। বা যখন কংগ্রেসের একটি অনশন মঞ্চ থেকে একটি ফোনে লাভপুরে কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশন চলে আসে, তখন এই স্বাতন্ত্র্যের দাবির ন্যায্যতা আরওই প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি বেসরকারি সংস্থার কর্পোরেট সোশাল রেসপনসিবিলিটির নজির হিসেবে এক লক্ষের বেশি মেয়ের সমীক্ষা করে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি কোন দশটি বিষয়কে প্রয়োজনীয় মনে করে, তা নিয়ে যে ইস্তেহারটি প্রকাশ করেছে, হিংসা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা সেখানে মুখ্য দাবি। উল্লেখযোগ্য দাবি— ছেলেদের লিঙ্গসচেতন করা আর এক কোটি শৌচালয় তৈরি।
এ রাজ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক দলের নারী সংগঠনরাও মেয়েদের দাবি নিয়ে স্বতন্ত্র ইস্তেহার তৈরি করছেন। সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি (সিপিআই-এম-এল’এর গণসংগঠন) ন্যায়, কাজ আর রাজনীতির জগতে সমান অংশীদারি, বেশ কিছু আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়নের দাবির সঙ্গে সম্পত্তির অধিকার, শৌচালয় আর পঞ্চায়েত স্তরে মেয়েদের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে মদের লাইসেন্স নিয়ন্ত্রণের দাবি তুলেছে। উল্লেখ্য অপুষ্টি আর রক্তাল্পতায় সামগ্রিক প্রকল্প, সেটি হয়তো খাদ্য সুরক্ষার নামান্তর। মহিলা সাংস্কৃতিক সংঘ (এস ইউ সি আই) জোর দিয়েছে নির্বাচনের সময় প্রার্থী বাছাইয়ের ওপরে।
সমস্যা অন্যত্র। মোটামুটি মার্চ মাসে সবার ইস্তেহার উপস্থিত হয়েছে। নির্বাচনের প্রথম দিন দলীয় বিজেপি-র ইস্তেহার প্রকাশ করার তাৎপর্যপূর্ণ ব্যতিক্রম বাদ দিলে লোকসভা নির্বাচনের ভোটে কাঠি পড়েছে তো সেই জানুয়ারির শুরু থেকেই। অনেকেরই ইস্তেহার মোটামুটি তৈরিই হয়ে ছিল, শুধু ভোটের সম্ভাব্য দিন ঘোষণা হলে আনুষ্ঠানিক প্রকাশটা হবে বলে। তা হলে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সংলাপে যাওয়ার সুযোগ কি তৈরি হল? না কি ইস্তেহারের অংশীদাররা সবাইকে বলবেন মেয়েরা নিজেরাই সব ভোটপ্রার্থীদের যেন বাজিয়ে নেন। রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা বাড়ি বাড়ি যখন যান, অনেক সময়ই পুরুষরা বাইরের কাজে, মেয়েরা ঘরে। তা হলে মেয়েদের যেন শুধু মূল্যবৃদ্ধি আর গ্যাসের দাম নিয়ে বললেই হবে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বলার দরকার নেই। এই প্রচারের মধ্যেও নারীপুরুষ বৈষম্যের ছাপ স্পষ্ট— পুরুষরা সবাই বিদেশ নীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন যে, তাঁরা বেশি বুঝবেন? যা-ই হোক, প্রার্থীদের বাজিয়ে নিতে গিয়ে কি নিজেরা প্রচারে নামা হবে? পছন্দ না হলে ‘কাউকে পছন্দ নয়’-এ ছাপ দিতে পরামর্শ? বেশ, তা হলে সাজিয়েগুছিয়ে নিজের ভোটটা নষ্ট করা গেল— এক ভোটের ব্যবধানেও যেখানে প্রার্থী জিততে পারে, সেখানে ‘নোটা’ কী বার্তা দেবে?
তা হলে কি মেয়েরা নিজেরা একটি রাজনৈতিক দল গড়বেন? পরিবেশ নিয়ে দাবি তুলে তিতিবিরক্ত গ্রিন পার্টি নিজেরাই রাজনৈতিক লড়াইয়ে নামবে বলে দল তৈরি করেছিল। কিন্তু তাদের দাবিগুলো ধীরে ধীরে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি নিয়ে নেওয়ায় আজ আর পশ্চিমে তাদের খুব প্রাসঙ্গিকতা নেই। মেয়েরাও কি নিজেদের দাবিগুলি রাজনৈতিক থেকে সামাজিক পরিসরে আনার জন্য সে রকম কিছু ভাববেন? তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেও আপাতত রাজনৈতিক দলগুলির এবং তাদের মনোনীত প্রার্থীদের নারীবিষয়ক মনোভাবের ইতিহাস নির্বাচনের বোতাম টেপার সময় মনে রাখবেন? আনিসুর রহমান বা পি সি সরকারের নারীবিষয়ক মশকরা মনে রাখবেন? মনে রাখবেন নির্বাচনী প্রচারের চাপ নিয়ে দেবের তুলনাটিও? মনে রাখবেন দলগুলির নারীবিষয়ক পদক্ষেপের ইতিহাসও? তবেই মেয়েরাও যে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বর্গ, মেয়েদের দাবিগুলিকে সামাজিকের আঙিনা থেকে রাজনৈতিকের পরিসরে আনাটাও রাজনীতিরই দায়িত্ব— সেটা স্বীকৃত এবং গৃহীত হতে শুরু করবে। না হলে ‘সুরক্ষা ছাড়া মেয়েদের সমান নাগরিক হয়ে ওঠা’র জন্য যেন আর কিছু প্রয়োজন নেই, এই স্থির বিশ্বাসটিকে বদলানো যাবে না।