এক ধরনের মানুষ আছে, অন্যের আনন্দে যাদের খুব অ্যালার্জি। ‘দ্যাখো, রাস্তা পার হওয়ার সময় খিলখিল করে গড়িয়ে যাচ্ছে, যেন হাসিটা পালিয়ে যাচ্ছিল। ওরে হাবা, গাড়িটা তোদের মাড়িয়ে দিলে কি ভাল হত? যৌবন যেন আমাদের ছিল না!’ কিন্তু তারা তো তখন নিজেদের উপচে যাওয়া আনন্দ খাবলা খাবলা ছোড়াছুড়ি করছে। যারা বেচারা ও সব জমানা পার হয়ে, জীবনের সপাট খেয়ে বা না খেয়েও চিরতার ব্যাপারি তাদের এ সবে ভারী রাগ। খামখা এত আনন্দের আছেটা কী? রবীন্দ্রনাথ বলল আর অমনি জগতে আনন্দযজ্ঞ ফ্রি? যে পারছে লুটেপুটে নিচ্ছে, লাইন ভেঙে ঢুকে যাচ্ছে অপার হ্যাপ্পিনেস জোন-এ? ওরে এত আনন্দ ধম্মে সইবে না।
এই যে ইরানে ক’টা ছেলেমেয়ে ফ্যারেল উইলিয়ামস-এর ‘হ্যাপি’ গানের সঙ্গে মহা ফুর্তিতে নেচে-টেচে একটা ভিডিয়ো তুলে ইন্টারনেটে দিয়েছিল, স্পেশাল অ্যালার্জির মানুষরা অমনি খপ করে তাদের ধরে জেলে পুরে দিল, নগ্ন করে প্যারেড করাল। অথচ এই গানটা গোটা বিশ্বে এখন হইহই জনপ্রিয়। ইউটিউবে ২৫ কোটি ‘হিট’ হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গার, বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই গানের সঙ্গে নিজেদের মতো নেচে-গেয়ে, রাস্তাঘাটে ফুর্তি করে ভিডিয়ো তুলে আপলোড করেছে। কেবল ইরানি ছেলেমেয়েদের ওপর খাঁড়া নেমে এল। প্রতিবাদও হল ফাটিয়ে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে ইরানের ছেলেমেয়েরা ঘোষণা করল, ‘হ্যাপিনেস ইজ আ ক্রাইম ইন ইরান’। ইরান টের পেল, বাইরের দুনিয়ায় ইমেজের ক্ষতি হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট টুইট করলেন, ‘আনন্দ থেকে উত্সারিত কোনও কাজকে দমন করা উচিত নয়’। অভিনেতাদের ছেড়ে দেওয়া হল তুরন্ত, যদিও পরিচালক মহাশয় আটক এখনও।
মোদ্দা কথাটা হল, এত আনন্দ উত্সারিত হবেই বা কেন? লোকজন আনন্দে থাকলে রাগ হয়। কেন? তার দুটো কারণ আছে। এক, অন্যে পেল আমি পেলাম না। আমি খারাপ থাকব কিন্তু অন্যে আনন্দ পাক না, তাতে কী এ বাস্তব ধারণ করার আধার সাধারণ মানুষের আত্মা নয়। আমাদের আনন্দ অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল টাকা, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, পছন্দসই বউ বা বর, আল্পস পর্বতে বেড়াতে যাওয়া, ক্ষমতা, খ্যাতি। নিজের মধ্যে ও নিজেকে নিয়ে আনন্দিত থাকার ক্ষমতা আমাদের নেই, তাই অন্যের আনন্দ যেন দুঃখকষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়।
কিন্তু এ তো চেনা সিনড্রোম। ভয়ানক হল দ্বিতীয়টা। কেউ আনন্দে থাকলে তাকে ঠিক বাগে আনা যায় না। সে আপন খেয়ালে, নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকে। তার ওপর অন্যের হম্বিতম্বি খাটে না। নিজেকে নিয়ে তুষ্ট থাকলে জাঁদরেল সব নিয়মকানুন তাকে পেড়ে ফেলতে পারে না। আর ঠিক সেটাই গায়ে জ্বালা ধরায়। হাত থেকে ফসকে যায় অন্যের ওপর আধিপত্য। অন্যের ওপর আধিপত্য চরম চাহিদা। আমি তাকে কতটা দাবিয়ে রাখতে পারলাম, আমার নিয়মে সে কতটা নত হল, আমার অঙ্গুলিহেলনে সে পেল প্রাণবায়ু তবে না মস্তি।
আনন্দ তো আসলে এক ধরনের মুক্তি। এই মুক্তিই ইরানের ‘সতী-সমাজের’ শত্রু। সমাজের সতীত্ব বজায় রাখাটা এতটাই জরুরি, না কি তাঁবে রাখাটা? দ্বিতীয়টাই আলবত সত্যি। কেন? মানুষ যত ভয়ে থাকবে, যত নিষেধে-বারণে থাকবে, তত সে নিজের অস্তিত্বের কথা ভুলতে থাকবে, হয়ে উঠবে নিষেধের প্রতি অনুগত। নিষেধ-অমান্যের ভয়ানক ফল তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। সে নিজের কাজ, নিজের কথা, নিজের অস্তিত্ব ভুলে ‘নিষেধ’ মান্য রাখার তাগিদে বুঁদ থাকবে। এই যে আত্মবিস্মৃত করে রাখা, এটাই ক্ষমতাবানের আসল ক্ষমতা। অন্যকে সন্ত্রস্ত রেখে নিজে গব্বর সিং।
আনন্দে থাকলে যে মানসিক স্বাধীনতাটা আসে, সেটা সব রকমের আধিপত্যকে অমান্য করতে শেখায়। আর তাতেই আধিপত্যের নায়কদের তীব্র বিরাগ। কামুর ‘আউটসাইডার’-এর নায়ক জেলবন্দি হওয়ার পর এক সময় একটা সিগারেট খেতে চায়। কিন্তু অনুমতি নেই। নায়ক প্রথমে বুঝতে পারে না সামান্য একটা সিগারেট খেলে কী অসুবিধে হবে। তার পর, জেলারের সঙ্গে আগে এক দিন যে কথাবার্তা হয়েছিল, তার সূত্র ধরে সে বুঝতে পারে, নিজের ইচ্ছেমত একটুও খুশি হয়ে ওঠার অবকাশ যদি কয়েদিকে দেওয়া হয়, তার স্বাধীনতাহীনতার শাস্তিটা তা হলে পূর্ণ হয় না। রাষ্ট্র তাকে আসলে দণ্ডিত করেছে আনন্দহীনতায়।
এই কারণেই অনেকে সংশোধনাগারের ধারণার বিরোধী। যে শাস্তি পেয়েছে, তাকে কেন অল্প হলেও মুক্তির স্বাদ দেওয়া হবে? জেলে সে যত বন্দি ছিল, সংশোধনাগারে তো সে তত বন্দি নয়, তার শরীর আর মন অন্তত কিছুটা মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। সে তো তত তাঁবে থাকছে না, যতটা রোজ পেটানি খেলে থাকত। শুধু শরীরটাকে জেলবন্দি করলে তো হবে না, মনের ওপরেও রাখতে হবে টুঁটি-টেপা নিয়ন্ত্রণ। জেলের নিত্যতায় তার মন যত ভেঙে আসবে, মার তাকে যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখবে, ছবি আঁকা বা গান শেখা তো সেই গিঁট আলগা করে দেবে! জীবন কিছুটা হলেও সহনীয় হয়ে যাবে। সে তো আর জেলকে ভয় পাবে না। বড়বাবু আসছে এই ঘোষণায় তার প্যান্ট হলদে হয়ে যাবে না।
আসলে, আনন্দ হল এমন একটা ‘বিষক্রিয়া’, যা দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে প্রচলিত সব ছক ভেঙে দেয়। চিন্তা একটাই শেষমেশ সবাই কি নিজের মতামতওয়ালা, যেমন চাই তেমন টাইপ স্বাধীন এক এক জন ব্যক্তি হয়ে উঠবে আর রাষ্ট্র বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষবে?