প্রত্যেকে টের পাচ্ছেন যে আমরা এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল যতই একতরফা হোক না কেন, এটা অনস্বীকার্য যে, কোনও একটি মতবাদ বা রাজনৈতিক অবস্থান সাধারণ মানুষের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। যেটা সুস্পষ্ট, সেটা হচ্ছে রং বদল: ব্যক্তিগত লাভের জন্য তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের জার্সি বদল। এটা শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, শুধুমাত্র ভারতবর্ষে নয়, এই ঘটনা বেশ কিছু কাল ধরে চলে আসছে সারা বিশ্বে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় যে দিন আমাদের আলোড়িত করল, সেই দিন থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক এবং দার্শনিকরা তাঁদের গতিপথ পাল্টাতে শুরু করেছিলেন। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে জানুসি, কঞ্চালভস্কিরা উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করলেন। হঠাৎ যেন মার্ক্সীয় দর্শনকে তাঁদের মূল্যহীন বলে মনে হতে লাগল। অথচ, সোভিয়েত আমলে বেশ কিছু অনন্যসাধারণ শিল্প-সৃষ্টি পৃথিবীকে চমৎকৃত করেছিল। এমনকী, তারকভস্কি— যিনি আলোকপ্রাপ্তির দর্শনকে প্রশ্ন করেছিলেন— তিনিও সেই সোভিয়েত চলচ্চিত্রের মধ্যে থেকেই বেড়ে উঠেছিলেন।
এই অশান্ত সময়ে একটি মানুষ কিন্তু তাঁর নিজের জায়গায় স্বমহিমায় বিরাজমান। তিনি চিত্রপরিচালক জঁ লুক গোদার, যাঁকে ফরাসি বলা যেতে পারে, আবার সুইসও বলা যেতে পারে। যে অনুসন্ধান গোদার শুরু করেছিলেন ষাটের দশকে, সেই খোঁজ, সেই বিশ্লেষণ তিনি আজও করে চলেছেন। আপাতদৃষ্টিতে তাঁর মুখ্য বিষয় হল চলচ্চিত্র নামক এই মাধ্যমটি। অর্থাৎ, চলচ্চিত্রের ধর্ম, তার প্রকৃতি, তার আঙ্গিক। আসলে, গোদার একাধারে এক জন চিত্রপরিচালক এবং চিত্রসমালোচক। তিনি এক জন তাত্ত্বিক বিশ্লেষক। ‘প্যাশন’ (১৯৮২), ‘কিং লিয়ার’ (১৯৮৭) এবং ‘জে এল জি/জে এল জি’ (১৯৯৪)-এর মতো ছবিতে, তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, চলচ্চিত্রকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। এবং সাম্প্রতিকতম ছবি ‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গোয়েজ’ (২০১৪)-এ এই কাজই তিনি আরও গভীর ভাবে সম্পন্ন করেছেন। ৮৩ বছর বয়সি গোদারের এই ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এই বছরে এবং সেটাও প্রতিযোগিতামূলক মুখ্য বিভাগে। শুধু তা-ই নয়, এই ছবিটি যে পুরস্কার পায়, সেটি প্রথম তিনটি পুরস্কারের মধ্যে একটি।
‘গুডবাই টু ল্যাঙ্গোয়েজ’ যেন এক অর্থে চলচ্চিত্রের বিদায় ঘোষণা করছে, আবার সেই চলচ্চিত্রের শতসহস্র অনুরণনকে সাধুবাদ জানাচ্ছে। এ ছবির নানা স্তর: এক দিকে আছে প্রকৃতি, অন্য দিকে ব্যঞ্জনা বা দৃশ্যকল্প। আর সারাক্ষণ একটি সারমেয় (যার নাম রস্কি) ঘুরে বেড়ায়। কেউ বলেন, ‘কুকুর কখনও উলঙ্গ নয়, কারণ সে সারাক্ষণই উলঙ্গ।’ এই বিমূর্ত প্রাবন্ধিক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গোদার যেমন চলচ্চিত্রকেই বিশ্লেষণ করছেন, অন্য দিকে তেমনই সমান্তরাল ভাবে তিনি সমাজ এবং উত্তরাধুনিক ভাবধারাকে উপস্থাপিত করছেন। উল্লেখিত ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন আলেকজান্ডার সলঝেনিত্সিন, আছেন অ্যাডল্ফ হিটলার। আজকের পৃথিবীর অস্থির, টালমাটাল চরিত্রকে তুলে ধরেছে এই ছবি; স্বৈরতন্ত্রের ভয়াবহতাকে যেমন প্রছন্ন ভাবে ইঙ্গিত করেছেন, ঠিক তেমন উত্তরাধুনিক পৃথিবীর ঠুনকো চরিত্রকে কটাক্ষ করেছেন। পরিশেষে, এক ঠান্ডা হতাশাই বিরাজমান। এ যেন গোদারেরই বিদায়। তিনি নিজে কান-এ আসতে পারেননি, তবে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন, ভিডিয়োর মাধ্যমে, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায়। সেই চিঠিতেও বিরহের সুর সুস্পষ্ট। গোদার কি স্বেচ্ছানির্বাসন নিলেন?
হতাশার কথা বললেও গোদার কিন্তু কোনও দিনই আমাদের হতাশ করেননি। কাহিনিকে, আখ্যানকে বর্জন করে যে-আঙ্গিক তৈরি করেছেন বিভিন্ন ছবিতে, তাতে সর্বদাই সরসতা উপস্থিত। মাঝে মধ্যেই হাসতে হয়, আবার অনেক সময় ধাক্কা খেতে হয়। বিতর্ক, পরস্পরবিরোধী মন্তব্য, অতিরেখ— সবই থাকে এই চিত্রপরিচালকের সৃষ্টিতে, তবে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত চালে। যাত্রা শুরু হয়েছিল ‘ব্রেথলেস’ (১৯৬০) ছবি দিয়ে— ফরাসি নবতরঙ্গের অন্যতম পরিচালক, জঁ লুক গোদার তখনও কাহিনিকে সম্পূর্ণ রূপে ত্যাগ করেননি। তবে একটি ‘গ্যাংস্টার’ ছবি তৈরি করতে গিয়ে তিনি ‘গ্যাংস্টার’ ছবি সম্পর্কে প্রায় একটা প্রবন্ধ রচনা করে ফেলেছিলেন। ‘উইকএন্ড’(১৯৬৭)-এর পর থেকেই কাহিনি ক্রমশ অপসৃত হয়েছে, উঠে এসেছে রাজনৈতিক বক্তব্য। বামপন্থার প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন না করে গোদার বামপন্থী রাজনীতিকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শুরু করলেন। সর্বন-এর ’৬৭-এর ঘটনা তাঁর ছবিতে স্থান পেল। বামপন্থাকে সমালোচনা করতে গিয়ে চলচ্চিত্রের তৎকালীন আখ্যানরূপকে আঘাত করলেন। আখ্যানের শরীরে বিভাজন ঘটালেন, কাহিনিকে ছিন্নভিন্ন করলেন, একটি দৃশ্যের সঙ্গে আর একটির পরস্পরবিরোধিতাকে তুলে ধরলেন, আবার চলচ্চিত্রের বাস্তবকে তুলে ধরে বলতে চাইলেন যে চলচ্চিত্র বাস্তবের থেকে ভিন্ন।
ব্রেখ্টকে রূপান্তরিত করে এক চলচ্চিত্র-উপযোগী দূরত্ব তৈরি করার প্রয়াস করলেন। ‘জয় অফ লার্নিং’ (১৯৬৯), ‘দ্য চাইনিজ’ (১৯৬৭) এবং ‘এভরিথিংস গোয়িং ফাইন’ (১৯৭২), এই ছবিগুলিতে পরিচালক চেষ্টা করেছিলেন দর্শককে জাগ্রত করতে, ভাবিত করতে, প্রশ্ন করতে; ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের কাহিনিতে সে যাতে মগ্ন হয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা নিলেন। আক্রান্ত দর্শক বাধ্য হয়ে চলচ্চিত্রকারকে সমালোচনা করবে, প্রশ্ন করবে, এবং এক নতুন সংলাপ তৈরি হবে, যার মাধ্যমে সমাজের নানাবিধ অন্যায়— যা কিনা লুক্কায়িত থাকে— সহজেই প্রকাশিত হবে।
আজও কিন্তু গোদার চলচ্চিত্রের প্রতি একই ভাবে দায়বদ্ধ। বাণিজ্যিক প্রলোভনকে অস্বীকার করে, নিজেকে নিজের জায়গায় দৃঢ়তার সঙ্গে আটকে রেখে কাজ করে চলেছেন। বদলে যাননি, তবে বদলকেও অগ্রাহ্য করেননি। ক্রমাগত নিজের শিল্পকে পরিশীলিত করতে করতে বহু চলচ্চিত্রকারকে প্রভাবিত করেছেন। বের্তোলুচি, ওশিমা, গ্লৌবার রোশা, এমনকি অগ্রজ মৃণাল সেনও গোদার দ্বারা প্রভাবিত। এই চলচ্চিত্রকাররা চলচ্চিত্রের ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন, তবে তাঁদের অনেকেই নিজেরা সমাজকে বদলানোর ইচ্ছে সরাসরি ভাবে প্রকাশ করেননি। একটা জিনিস তাঁরা চেয়েছেন: আমরা যে-ভাবে ভাবি, যে-ভাবে ভেবে আসছি, সেটা বদলানোর চেষ্টা হোক। যা বহু যুগ ধরে গোদার চেষ্টা করে চলেছেন।
পরিশেষে একটাই কথা। ‘বুদ্ধি থেকে যদি ক্ষমতার জন্ম হয়, তা হলে সেই ক্ষমতার ধাক্কায়, যেটুকু বুদ্ধি ছিল, তাও লোপ পায়’। ২০০১ সালে নির্মিত, ‘স্বপ্নের সন্ধানে’ ছবিটিতে আমি এই উদ্ধৃতাংশ প্রয়োগ করেছিলাম। গোদার ভাষাকে বিদায় জানিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন যে, আজকের বুদ্ধিজীবীরা ক্ষমতা এবং অর্থ, সেই সঙ্গে খ্যাতি— এ সবেরই দাসত্ব করছেন। তাই, এই অধুনান্তিক পৃথিবীতে, বুদ্ধিজীবীদের বাণীর জন্য অপেক্ষা করার কোনও মানে আছে কি?