জোট শাসন বস্তুটির প্রথম ও প্রধান চারিত্রলক্ষণ হইল, টানাপড়েন। বহু-দললাঞ্ছিত গণতন্ত্র ভারতে গত কয়েক দশকের ইতিহাস যথেষ্ট ভাবে প্রমাণ করিয়াছে, কত প্রবল সংকটময় হইতে পারে জোট শাসনের বাস্তব। সেই ইতিহাস হইতে যদি কিছু শিক্ষণীয় থাকে, তাহা সমঝোতা। বহু টানাপড়েনের মধ্যেও জোটের বাস্তবটিকে চলমান ও অর্থময় রাখিতে পারা। জম্মু ও কাশ্মীরে এই মুহূর্তে যাহা চলিতেছে, তাহা আবারও জোট-শাসনের অবধারিত হতাশাজনক ভবিতব্য মনে করাইয়া দেয়। রাজ্যে পিডিপি ও বিজেপি-র যুগ্ম সরকার প্রতিষ্ঠিত হইবার অব্যবহিত পরই যে ভাবে একটিমাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া দুই শরিক দলের প্রবল দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইয়াছে, এবং সেই সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় শাসক দল বিজেপি যে অতিসক্রিয়তা দেখাইতেছে, তাহা এক কথায়, অবাঞ্ছিত। কোনও বিষয় লইয়াই এত উত্তপ্ততার প্রয়োজন ছিল না। প্রথম কদমেই যদি সমঝোতার মানসিকতা হইতে এত বড় বিচ্যুতি হয়, তবে কোনও দলই পরস্পরের সহিত হাত মিলাইয়া সরকার তৈরির মতো হঠকারিতা না দেখাইলেই পারিত।
মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সইদ সম্প্রতি কট্টর হুরিয়ত নেতা মাসারত আলমকে জেল হইতে ছাড়িয়া দেওয়াতেই সংকটের উদ্ভব। তাঁহার দলের বক্তব্য, কোনও বিশেষ অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও এই নেতাকে আটকাইয়া রাখিবার যুক্তি নাই। ইহাও ইতিমধ্যে প্রকাশিত যে এই সরকার ক্ষমতায় আসিবার আগেই স্বরাষ্ট্র দফতরের নির্দেশে মাসারত আলমকে মুক্তি দিবার প্রস্তাব আসিয়াছিল। প্রশ্ন উঠিতে পারে, যুক্তি যাহাই হউক, পদ্ধতি অনুযায়ী পিডিপি-র আরও একটু সংযমী ও আলোচনা-অনুগামী হওয়া উচিত ছিল কি না। মুশকিল এখানেই যে সেই পদ্ধতিগত প্রশ্নের মধ্যে না ঢুকিয়া বিজেপি কেবলই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নামক বহুচর্বিত ধুয়াটির আশ্রয় লইয়াছে। অথচ কোনও যুক্তিতেই অনভিযুক্ত ব্যক্তিকে বন্দি করিয়া রাখা চলে না। কাশ্মীরের মতো পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া যে সম্পন্ন হইয়াছে, মুফতির মতো নেতাকে যে সকল গোষ্ঠীর কাশ্মীরি মুসলিমরা বিক্ষোভসহকারেও শেষ পর্যন্ত মানিয়া লইয়াছেন, এবং বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলানো সত্ত্বেও নবগঠিত সরকারের বিরোধিতা করেন নাই, তাহাতেই বোঝা যায়, এই সরকার বিষয়ে রাজ্যের বাহিরের সকল শক্তির অত্যন্ত সাবধানী ও সংযমী থাকা প্রয়োজন। জোট সরকারের জন্য সাধারণ অর্থে সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও জম্মু ও কাশ্মীরের মতো সংবেদনশীল রাজ্যের ক্ষেত্রে কেন এই বিশেষ ধৈর্য ও সংযম দরকার, বিক্ষোভ-মত্ত লালকৃষ্ণ আডবাণীদের তাহা না বুঝিবার কথা নয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে, যে সন্দেহ কাশ্মীরবাসীর মজ্জাগত, সেই সন্দেহ উদ্রেক করিবার মতো আলোচনা ইতিমধ্যেই দিল্লির আনাচে কানাচে শুরু হইয়াছে। যদি জোট সরকার পড়িয়া যায়, তবে আবারও রাজ্যপালের শাসন জারি হইবে। অর্থাত্ বকলমে কেন্দ্রের হাতে রাজ্যের রাশ চলিয়া যাইবে। গত কয়েক দশকের ইতিহাসে বারংবার দিল্লির অতি-নিয়ন্ত্রণের পাকেচক্রে কাশ্মীর উপত্যকার রাজনীতি জটিলতর ও উগ্রতর হইয়াছে। এখনই সরকার পড়িয়া গেলে আবারও সেই সম্ভাবনা তৈরি হইতে পারে। লক্ষণীয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে দাঁড়াইয়া স্পষ্টাক্ষরে দুই পক্ষের সমঝোতার অত্যন্ত জরুরি দায়িত্বের কথা মনে করাইয়া দিলেও বিজেপি-র দলীয় উগ্র অবস্থানে কিন্তু তিনি মদত দেন নাই। এখনও পর্যন্ত প্রধান নেতৃত্বের এই সংযমটুকুই আশার আলোক। নতুবা একটিমাত্র ঘটনার মূল্য হিসাবে এত বড় সুযোগের অসদ্ব্যবহার ভবিষ্যত্ ইতিহাসে একটি বড় কালিমা-মুহূর্ত হইয়া থাকিবে।