প্রবন্ধ ১

চমকের পরে বিদেশ নীতি কোন দিকে

মোদীর অভিষেক-কূটনীতিতে প্রতিবেশীদের প্রচ্ছন্ন ভাবে নিজস্ব শক্তি প্রদর্শনের ইঙ্গিত স্পষ্ট। কিন্তু এই কূটনীতির সরণি বেয়ে সুসংহত প্রতিবেশ নীতি গড়ে তোলাও নয়াদিল্লির পক্ষে অসম্ভব নয়। সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী।নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মুহূর্তেই দেশের বিদেশ নীতি, বিশেষ করে প্রতিবেশ নীতিতে এক ধরনের চমক সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। ভারতের আদৌ কোনও প্রতিবেশ নীতি ছিল বা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৪ ০০:০০
Share:

নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী ভারতের পঞ্চদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার মুহূর্তেই দেশের বিদেশ নীতি, বিশেষ করে প্রতিবেশ নীতিতে এক ধরনের চমক সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। ভারতের আদৌ কোনও প্রতিবেশ নীতি ছিল বা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বা সুসংহত চিন্তাভাবনার খামতি ইদানীং বেশ লক্ষ করা গেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক-এর শীর্ষ নেতা ও সেই সঙ্গে মরিশাসের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো অবশ্যই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

Advertisement

পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ জানিয়েছেন যে, ১৯৯৯ সালে তাঁর এবং প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর মধ্যে যে লাহৌর ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা প্রশমন সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী মোদী ও তাঁর মধ্যে আলোচনা নির্ধারিত আধ ঘণ্টা ছাড়িয়ে মিনিট পঞ্চাশেক ধরে চলেছে। উল্লেখ্য, মোদীর আমন্ত্রণ পাওয়ার পরে শরিফ এ দেশে আসবার ঠিক আগেই পাক সরকার সে দেশের জেলে আটক ১৫১ জন ভারতীয় মৎস্যজীবীকে মুক্তি দিয়েছে। প্রতিসৌহার্দ্যের হাত বাড়িয়ে চার দিনের মধ্যে ভারতও এ দেশের জেলে আটক ৩৭ জন পাকিস্তানি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। এঁদের মধ্যে মৎস্যজীবী ছাড়াও অন্যান্য অসামরিক ব্যক্তিও রয়েছেন। এর পরেও অবশ্য দুই দেশের জেলে আটক পরস্পরের মৎস্যজীবী বা অন্য অসামরিক ব্যক্তিদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তবে মোদীর অভিষেক-কূটনীতির জেরে ওইটুকু প্রাপ্তিও তলানিতে ঠেকা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কম নয়।

Advertisement

অশনি সংকেত

ভুললে চলবে না যে, মোদীর অভিষেকের ঠিক আগেই আফগানিস্তানের হেরাটে ভারতীয় দূতাবাসে জঙ্গিরা আক্রমণ চালিয়েছিল। ভারতীয় ও আফগান নিরাপত্তারক্ষীরা সে আক্রমণ প্রতিহত করলেও এই অঞ্চলের কূটনৈতিক সম্পর্কের পক্ষে এ এক অশনি সংকেত। কারণ, পাক মদতে লস্কর-ই-তইবা-র জঙ্গিরাই এই হানাদারির পিছনে বলে অভিযোগ। মোদী-শরিফের আলোচনায় এই প্রসঙ্গ আলোচিতও হয়েছে। মুম্বই হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাকিস্তানে আটক ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের দাবিও নতুন প্রধানমন্ত্রী মোদী শরিফকে জানিয়েছেন। পাশাপাশি, এই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কথাও এসেছে।

শরিফ ঠিকই বলেছেন। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীই সম্প্রতি বিপুল জনসমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছেন। অতএব, সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে উভয়ের প্রয়াস সফল হওয়ার কথা। কিন্তু মোদীর আমন্ত্রণে শরিফের ভারতে আসার পথ সুগম ছিল না মোটেই। পাক রাজনীতিতে নির্বাচিত সরকারের পাশাপাশি সে দেশের সেনাবাহিনী, গুপ্তচর সংস্থা ও মোল্লাতন্ত্রের ক্ষমতাও যে মোটেই উপেক্ষণীয় নয়, তা আজ সুবিদিত। হেরাট হামলাও হয়তো ক্ষমতার এই অশুভ অক্ষের সঙ্গেই সম্পর্কিত। তাই আসার আগেই শরিফকে হোঁচট খেতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অনেকাংশে তাঁর ভাই ও পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের দৌত্যে তিনি মোদীর আমন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন। মোদী সকাশে যাওয়ার আগে দিল্লিতে জামা মসজিদ ও ঐতিহাসিক লালকেল্লায় গিয়ে সম্ভবত তিনি স্বদেশের কট্টরপন্থীদেরও এক ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন। অদূর অতীতে কার্গিল যুদ্ধের জেরে লাহৌর-দৌত্য যে ভাবে বেলাইন হয়েছিল, তা শরিফের থেকে ভাল আর ক’জনই বা জানেন! সুতরাং, মোদী-শরিফের এই বৈঠক থেকে এখনই খুব বেশি আশা করা সঙ্গত নয়। অন্য দিকে, মোদীর এই রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক চাল কতটা প্রতিবেশীদের সামনে নিজের শক্তি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আর কতটা পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতির লক্ষ্যে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে, মোদীর এই অভিষেক-লগ্নের বেনজির কূটনীতির সময়ে কিছু সংবাদমাধ্যমের অতিজাতীয়তাবাদী অবস্থান একেবারেই কাঙ্ক্ষিত ছিল না।

প্রতিবেশী নজর

ভারত আর পাকিস্তানের শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাতের অভিঘাতে অভিষেক-কূটনীতির বাকি প্রয়াস অন্তরালে যাওয়াই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু এটা অত্যন্ত তাৎপর্যের যে, তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে নজিরবিহীন ভাবে মোদী প্রতিবেশী দেশের সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমেরিকা, চিন বা রাশিয়াকে বিন্দুমাত্র উপেক্ষা না করেও যে নয়াদিল্লি তার প্রতিবেশীদের গুরুত্ব দিতে পারে, এ ক্ষেত্রে তা প্রমাণিত। নির্বাচনী প্রচারে নরেন্দ্র মোদী বেশ কয়েক বার ভারতের কয়েকটি প্রতিবেশী দেশকে তাঁর আক্রমণের নিশানা বানিয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে এই কূটনৈতিক চালের তাৎরর্য আরও বেশি।

হেরাট হানা প্রতিহত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদী যেমন আফগানিস্তানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, তেমনই বিদেশ সচিব পরিষ্কার জানিয়েছেন যে, আফগানিস্তানের নিজস্ব প্রয়াসেই সে দেশের যাবতীয় সমস্যা মিটুক, ভারত তা-ই চায়। এক অর্থে শরিফ ও কারজাইয়ের এই ভারত সফর এটা প্রমাণ করে যে, হেরাট কাণ্ডকে গুরুত্বহীন প্রমাণ করতে ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান— তিন দেশের রাষ্ট্রনেতাই বদ্ধপরিকর।

উল্লেখ্য, আগামী এক দশকে ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। জ্বালানি ব্যবহারে, চিন, আমেরিকা, রাশিয়া এবং মায়ানমারের সঙ্গে সহযোগিতার বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলে চিন ভারতের থেকে এ বিষয়ে যথেষ্ট এগিয়ে। তুর্কমেনিস্তান কিংবা ইরান থেকে ভারতে জ্বালানির জোগান সুনিশ্চিত করতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা নয়াদিল্লির পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। আশার কথা এটাই যে, বিজেপি তার ইস্তেহারে জ্বালানিকে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে এক বন্ধনীতে রেখেছিল এবং দাবি করেছিল যে, জ্বালানির জোগানের ঘাটতি যাতে ভারতের আর্থিক বিকাশের অন্তরায় না হয় তা দেখা জরুরি।

তামিল রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ক্ষোভ ব্যক্ত করলেও শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মহেন্দ্র রাজাপক্ষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নরেন্দ্র মোদী স্পষ্ট সংকেত দিতে চেয়েছেন যে, ভারতের বিদেশ নীতিকে দেশের আঞ্চলিক দলগুলির স্বার্থের কাছে সঁপে দিতে তাঁর সরকার প্রস্তুত নয়। আবার, শ্রীলঙ্কার তামিল বংশোদ্ভূতদের অধিকার রক্ষার তাগিদে সে দেশের সংবিধানের প্রায়-বিস্মৃত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বাস্তবায়নের কথাও সফররত প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে মোদী তামিলনাড়ুকে রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশ থেকে ‘বেআইনি অনুপ্রবেশ’-এর যে প্রসঙ্গে মোদী তাঁর নির্বাচনী প্রচারে সরব হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিনিধিত্বকারী সে দেশের জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে আলোচনার সময়ে তা ফের উত্থাপিত হয়েছে। তিস্তার জল বণ্টন প্রসঙ্গ বা ছিটমহলের বিষয় আলোচনায় এলেও টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গ অবশ্য আলোচনায় আসেনি। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে ছিটমহলের যে সব এলাকা নিয়ে বিতর্ক নেই, তার দ্রুত সমাধানের ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বস্তুত, মোদীর অভিষেক-কূটনীতিতে রাজনীতির কূটকচালি আছে। প্রতিবেশীদের প্রচ্ছন্ন ভাবে নিজস্ব শক্তি প্রদর্শনের ইঙ্গিতও বেশ স্পষ্ট। তা সত্ত্বেও মোটের উপর এই প্রচেষ্টা শুভ। এই কূটনীতির সরণি বেয়ে সুসংহত প্রতিবেশ নীতি গড়ে তোলাও নয়াদিল্লির পক্ষে অসম্ভব নয়। আগামী নভেম্বর মাসে বছর তিনেক বাদে নেপালে অষ্টাদশ সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হতে চলেছে। তার মধ্যে মোদী সরকারের বিদেশ নীতির অভিমুখ নিশ্চিত ভাবেই স্পষ্টতর হবে।

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement