আলু সংকটের পর থেকে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে। তা হল, রাজ্যের প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আলু উত্পন্ন হয়েছে বলে যখন চাষির এই দুর্দশা, তখন আগামী বছর থেকে আগে বুঝে নেওয়া যাক, এ রাজ্যের বাজারে আলুর চাহিদা কতটা। সেই অনুসারে কেবল সেই পরিমাণ, কিংবা তার চাইতেও কম আলু ফলাক চাষিরা। তা হলে তারা লাভবান হবে।
ঘটনা হল, কেবল নিজের রাজ্যের জন্য, নিজের এলাকার জন্য কৃষিপণ্য উত্পন্ন করে কোনও চাষি ভাল লাভ করতে পারে না। লাভ আসে উন্নত মানের ফসল চড়া দরে রফতানি থেকে, তা ভিন্ রাজ্যেই হোক, আর ভিন্ দেশেই হোক। ভারতে সব চাইতে বিত্তবান চাষিদের মধ্যে রয়েছেন পঞ্জাবের চাষিরা। সরু, উন্নত মানের বাসমতী চাল উত্পাদন করেন তাঁরা। তার প্রায় সবটাই রফতানির জন্য। পঞ্জাবে ভাত খাওয়ার চল কম। বাজারে যে ধরনের লম্বা দানা চালের চাহিদা রয়েছে, ঠিক তেমন চালই পঞ্জাবের চাষিরা তৈরি করেন এবং রফতানি করেন পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে। গুজরাতে ক্যাস্টর, গুয়ার থেকে কেরল, তামিলনাড়ুর লবঙ্গ, দারচিনি, যে দিকেই আমরা দেখি না কেন, চড়া দামে রফতানি করতে পারে বলেই চাষি একটা ভদ্রগোছের জীবন পেয়েছে। এমনকী বিটি তুলো, বিদর্ভের চাষিদের আত্মহত্যার সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে গিয়েছে, তা-ও কিন্তু গুজরাতের চাষিদের ভাল লাভ দিচ্ছে। নিজেদের প্রয়োজনের জন্য কম-দামি, নিচু-মানের শস্য প্রয়োজন হলে, সেটা বরং কম টাকায় অন্য জায়গা থেকে কেনা ভাল।
যেমন করে চিন। তাদের কৃষিজাত আমদানির তালিকার উপরে সয়াবিন আর তুলো। এই দুটোই উত্পাদন করতে অনেক জমি লাগে, যা চিনের নেই। চিন দেশটা ভারতের চাইতে অনেক বড় হলেও, কৃষিজমি ভারতের চাইতেও কম, যদিও উন্নত সেচ আর উন্নত প্রযুক্তির জন্য একর-প্রতি উত্পাদনশীলতা ভারতকে অনেক দিন ছাড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজের সেই জমি প্রধানত উঁচু দামের ফসলের জন্য ব্যবহার করে চিন। শেষ অবধি ছবিটা দাঁড়ায় এই, চিন ভারতকে রফতানি করছে আপেল, নাসপাতি, ফলের রস। আর ভারত থেকে নিচ্ছে সয়াবিন আর তুলো। কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্ব থেকেই প্রচুর সয়াবিন আমদানি করে চিন, যা তারা প্রধানত পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। কম দামের শস্য আমদানি করে চড়া দামের পণ্য রফতানি, লাভ করতে হলে এটা অন্যতম পথ।
এ রাজ্যে ঝোঁকটা ঠিক উল্টো। ‘আমরা কত শস্তায় কত ভাল জিনিস খাব,’ এই প্রশ্নটা এত বড় হয়ে ওঠে যে ‘চাষি কত কম খরচে কত বেশি লাভ করবে,’ সেই প্রশ্নটা ছোট হয়ে যায়। সেই জন্য আমরা বছরের পর বছর হিমসাগর বা ল্যাংড়া আমের গুণগান গেয়ে চলেছি, যেখানে দেশবিদেশের বাজার ধরছে আলফনসো। হিমসাগর স্বাদে যতই উত্কৃষ্ট হোক, গাছ থেকে নামার পর দু’দিনও তাজা থাকতে চায় না, তার শাঁস আটোসাটো নয়। অন্য রাজ্যের চাষি যেখানে বছর বছর আরও উন্নতমানের, অধিক-চাহিদার ফল তৈরি করছেন, সেখানে আমাদের আমচাষিরা কেবলই রাজ্যের বাজারের জন্য ফল ফলিয়ে যাচ্ছেন। বহু বছর ধরে চাষ করেও তাঁদের উন্নতি হয়নি। আলুর ক্ষেত্রেও তাই। সিমলার কেন্দ্রীয় আলু গবেষণা কেন্দ্র বলছে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তাইল্যান্ডের মতো দেশে আলু রফতানির মস্ত সুযোগ রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের। কিন্তু যে ধরনের আলু রফতানি হয়, কিংবা চিপস বা স্টার্চ তৈরির শিল্পে লাগে, তাতে জলের অংশ কম থাকে। এ রাজ্যের আলুতে জলের অংশ বেশি। রফতানি বা শিল্পের জন্য অন্য প্রজাতির আলু ফলাতে হবে।
এখানে তা হচ্ছে না, কারণ এখানে চাষিদের বলা হয়, কৃষির জন্য অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করাই যথেষ্ট, রফতানিটা ফাউ। এই চিন্তাটা ভুল। রফতানি না করলে চাষ লাভজনক হয় না, চাষের পদ্ধতিতে উন্নতি আসে না, কৃষি উত্পাদনে বৃদ্ধিও হয় না। এ রাজ্যে চাষিদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সরকার বার বার একটাই পন্থা নেয়। তা হল শস্তায় চাষিদের থেকে ফসল কিনে নিয়ে তা ফের কম টাকায় সাধারণ ক্রেতাকে বিক্রি করা। এই ধারণাটাই হাস্যকর। বাজারে আলু, সব্জি বিক্রি করা কি সরকারের কাজ? চাইলেও এ ভাবে চাষির ক্ষতি সামাল দিতে পারে না সরকার, সে কথা চাষিরাও ভাল বোঝেন।
সরকারের কাজ তা হলে কী? কৃষিপণ্য পরিবহণ ও বিপণনের পরিকাঠামো তৈরি করা, এটাই সরকারের প্রধান কাজ। বড়জোর, কৃষি বিষয়ক সুযোগসুবিধে যা সরকার দিচ্ছে, যেমন চাষের নতুন পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ, বা ভর্তুকিতে বীজ, সার বিতরণ (রাজনৈতিক কারণে যেগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না সরকার) তার তথ্য পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পারে চাষিদের কাছে। বাকিটা বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে সরকারকে।
এই ছেেড় দিতে পারাটা েয কোনও সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। লাভের প্রথম উপায় রফতানি, যার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি। দেশে-বিদেশে আলুর বাজারে কোথায় কতটা চাহিদা রয়েছে, তা বুঝে কোন বাজারে কত আলু যাবে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বেঁধে উত্পাদনে নামতে হবে। তখন আলুর উত্পাদনের পদ্ধতি (রোগ প্রতিরোধ, কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ) থেকে সংরক্ষণ, প্যাকেজিং, সবই নির্দিষ্ট মানের হতে হবে। কিন্তু আলু নিয়ে এমন ‘রফতানি নীতি’ তৈরি করা সরকারের কাছে ঝুঁকির। আলু, পেঁয়াজ, এগুলো খাদ্যে মূল্যস্ফীতির নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুধ বা ডিমের দাম বাড়লে তা নিয়ে কেউ টুঁ শব্দটি করে না, কিন্তু আলু বা পেঁয়াজের দাম মাসখানেকের জন্য বাড়লেও জনরোষের চাপ বাড়তে থাকে। ফলে রফতানি বন্ধ করে স্থানীয় বাজারে দাম কমানো জরুরি বলে মনে হতে থাকে সরকারের কাছে।
একেই তো পশ্চিমবঙ্গের বাজারে আলুর দাম গড়ে অন্য অধিকাংশ রাজ্যের চাইতে বেশি কিছুটা কম। সেই সঙ্গে, গত আট-দশ বছরের হিসেব কষলে দেখা যাবে, অধিকাংশ বছরই এ রাজ্যের বাজারে আলুর দাম কম ছিল, দু-এক বছর বেড়েছে। তা-ও শহরের বাইরে গ্রাম বা মফস্সল, যেখানে অধিকাংশ গরিব মানুষ থাকেন, সেখানে দাম শহরের বাজারের চাইতে কমই থাকে। গত বছর জোর করে আলুর দাম কম রাখতে রফতানি আটকেছিল সরকার, তাতে এ রাজ্যের উপর আস্থা হারিয়ে অন্য রাজ্যগুলো এ বছর বেশি আলু উত্পাদন করেছে। এ বার তারই মূল্য চোকাচ্ছেন চাষিরা। সরকারের দৃষ্টিতে রফতানি হল ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’। আলু রফতানির সুষ্ঠু নীতি কোনও রাজ্যেই নেই। অথচ তেমন নীতি তৈরি না হলে লাভজনক আলুচাষ প্রায় অসম্ভব, সেটাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
লাভের দ্বিতীয় উপায় হল চুক্তি-চাষ। এখানেও সরকারি তরফে সমস্যা রয়েছে। চুক্তি-চাষে চাষির মস্ত ঝুঁকি, এই প্রচারটা সব দলের নেতারা জারি রেখেছেন। অথচ ঝুঁকিটা ঠিক কোথায়, তা তাঁরা স্পষ্ট করেন না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, চাষির জমি লিজ নেয় বাণিজ্যিক সংস্থা, নিজের জমিতে কাজ করে মজুরি পান চাষি, সেই সঙ্গে ফসল বিক্রি করে একটা নির্দিষ্ট হারে লাভও করেন। এ রাজ্যে আলু চাষের এই দুর্দিনেও একটি বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ চাষিরা আলু ফলিয়ে যথেষ্ট লাভ করেছেন। যদি দেখা যায়, চুক্তিচাষ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে যে চাষের নকশাই বদলে যাচ্ছে, তা হলে খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে পারে। না হলে চুক্তিতে আপত্তি কেন?
অথচ যখন প্রশ্ন ওঠে, কেন চাষে ক্ষতি হচ্ছে, তখন দূরদৃষ্টিহীন, বাণিজ্যবুদ্ধিশূন্য কৃষি নীতির দিকে না তাকিয়ে আঙুল তোলা হয় চাষির দিকে। সে কেন বেশি লাভের আশায় আলু চাষ করতে গিয়েছিল? যেন লাভের আশা করা অন্যায়। কোনও মতে বেঁচে থাকাই চাষির ভবিতব্য। যা আলু এ বার ফলেছে, তার ঢের বেশি ফলিয়েও চাষি লাভ করতে পারে, যদি উৎপাদন, বিপণন ও রফতানির নীতি চাষির কথা ভেবে তৈরি হয়।
লেখক কৃষিবিশেষজ্ঞ, বিশ্বভারতীর সহ-উপাচার্য।