বৃদ্ধি। আমদাবাদের কাছে আখের খেত, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ছবি: রয়টার্স।
জনমানসে কী ভাবে যেন একটা ধারণা গড়ে উঠেছে যে, গুজরাত মানেই শুধু বৃহত্ শিল্প ও নগরায়ণের প্রসার। এবং যেহেতু গুজরাতের শ্রীবৃদ্ধি মূলত নগরকেন্দ্রিক, তাই বোধহয় গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব ও দারিদ্রের বেশ প্রভাব আছে। আবার বিপরীতে, এমন প্রচারও আছে যে, যেহেতু সুদীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে বাম রাজত্বকালে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ মানুষের লাগাতার ক্ষমতায়ন ঘটেছে, তাই কর্মসংস্থানের নিরিখে বোধহয় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের পরিস্থিতি গুজরাতের চাইতে ভাল। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার পরিসংখ্যান কী বলছে এ ব্যাপারে?
এক বছর সময়ের মধ্যে যদি কেউ দীর্ঘকালীন সময় ধরে (১৮৩ দিন বা তার বেশি) বেকার থাকে (কাজ চাইছে, কিন্তু কাজ পাচ্ছে না), তবে সে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্বের আওতায় পড়বে। ১৯৯৩-৯৪ সালে গুজরাতের গ্রামে ক্রনিক বেকারত্বের হার ছিল ১.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে ছিল ৩.০ শতাংশ। জাতীয় গড় (গ্রামীণ) ছিল ১.৮ শতাংশ। অর্থাত্, গুজরাত ও জাতীয় গড় দুইয়ের চাইতেই পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা খারাপ ছিল। এর পর, গ্রামীণ ক্রনিক বেকারত্বের হার পশ্চিমবঙ্গে লাগাতার বাড়তে বাড়তে ২০০৫-০৬-এ প্রায় ৩.৯ শতাংশে পৌঁছয়। অথচ, গুজরাতের গ্রামে ওই বছরে তা ছিল ১.১ শতাংশ এবং তার আগের দু’টি সমীক্ষায় ১৯৯৯-০০ ও ২০০৪-০৫-এ হারটি ১ শতাংশেরও নীচে নেমে গিয়েছিল।
এর পর পশ্চিমবঙ্গের উদ্ধারকর্তা রূপে অবতীর্ণ হয় কেন্দ্রীয় সরকারের একশো দিনের কাজের প্রকল্প, নইলে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে পরের বছরগুলিতে গ্রামীণ বেকারত্বের হার আরও বেড়ে যেত। কারণ, একটানা গ্রামীণ বেকারত্বের হার বৃদ্ধিতে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, কৃষিক্ষেত্র আর বেশি কর্মসংস্থানের হদিশ দিতে পারছিল না, ও দিকে আবার শিল্পেরও দেখা নেই। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের প্রভাবে ২০০৭-০৮ ও ২০০৯-১০-এ গ্রামীণ বেকারত্বের হার পশ্চিমবঙ্গে নেমে এল যথাক্রমে ৩.৩ ও ২.৭ শতাংশে। ওই বছর দু’টিতে গুজরাতে তা ছিল ১ শতাংশেরও নীচে।
তবে, গুজরাতের অ-কৃষিক্ষেত্রে (শিল্প ও পরিষেবা) যতই উন্নতি হয়ে থাকুক না কেন, রাজ্যের মোট কর্মরত মানুষের ৫৪.৪ শতাংশ কিন্তু এখনও কৃষিক্ষেত্রে নিযুক্ত। অর্থাত্, একটি অঞ্চলের উন্নত থেকে উন্নততর অবস্থায় পৌঁছতে গেলে শুধু অ-কৃষিক্ষেত্রের ‘আয়’ দ্রুত বাড়লেই এবং সেই ক্ষেত্রগুলিতে পুঁজির স্ফুরণ ঘটলেই চলবে না, অ-কৃষিক্ষেত্রে প্রচুর কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে কি না, কৃষি থেকে শ্রমিকরা অ-কৃষিক্ষেত্রের দিকে বেশি যাচ্ছে কি না, তা-ও বিচার্য। যেহেতু এ ব্যাপারটা এখনও বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে না, তাই গুজরাতের ‘গ্রোথ’-এ গ্রামীণ মানুষের অবস্থানটা ঠিক কোথায়, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে।
তবে, এটা রাতারাতি ঘটবে না। গ্রামের কৃষিনির্ভর, নিরক্ষর কিংবা অল্পশিক্ষিত তথা অদক্ষ শ্রমিকের জন্যে অ-কৃষিক্ষেত্রে দ্রুত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা দুরূহ, বিশেষ করে যখন শিল্পে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ভীষণই কম। এ ক্ষেত্রে দু’টি কাজ করণীয়। এক, কৃষিকে অবহেলা না করা, কারণ কৃষিই বহু গ্রামীণ মানুষের ভরসা। দুই, গ্রামীণ অ-কৃষিক্ষেত্র (গ্রামীণ ক্ষুদ্রশিল্প)-এর প্রসার ঘটানো, যাতে করে গ্রামের অদক্ষ ও স্বল্পদক্ষ মানুষ অ-কৃষিক্ষেত্রে সরে যাবার সুযোগ পায়। কারণ, কৃষি তার উত্পাদনশীলতা বাড়ানোর জন্যে উন্নত প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়বে, আর তার ফলে কৃষিতে কায়িক শ্রমের চাহিদা কমবে। তাই, অ-কৃষিক্ষেত্রের দিকে ঝুঁকে পড়া ছাড়া গ্রামীণ শ্রমিকের একটা অংশের কোনও গতি থাকবে না। অর্থনীতিতে এ জাতীয় পরিবর্তনের প্রক্রিয়া বেশ জটিল হয়। বিশেষ করে, যেখানে দরিদ্রের সংখ্যা একটা চিন্তার বিষয়।
লক্ষণীয়, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়া ব্যক্তিমন তথা সমাজমনেও প্রভাব ফেলে। যেমন, সমাজের একটা অংশ এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়, আবার ট্র্যাডিশনের ভাঙচুর দেখে অন্য অংশের মন যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়। যে সমাজে প্রথম অংশের সংখ্যাধিক্য, সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা থাকে। অন্য রকমও দেখা যায়। গুজরাতিরা খুবই ধর্মপ্রাণ ও সনাতন প্রথা মেনে চলা জাতি, অথচ ব্যবসার ক্ষেত্রে ভারতে তারাই বেশি অগ্রগণ্য।
গুজরাতে দ্রুত শিল্পায়ন ঘটছে, অথচ গ্রামের প্রচুর মানুষ এখনও কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাদের রাতারাতি নগরভিত্তিক শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এক দিকে কৃষিক্ষেত্রকে উজ্জীবিত রাখতে হবে, অন্য দিকে গ্রামীণ অ-কৃষিক্ষেত্রের পরিসর তৈরি করতে হবে। কৃষিজাত দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতেও কৃষিকে চাঙ্গা রাখা প্রয়োজন। অথচ গুজরাত খরাপ্রবণ রাজ্য, প্রায় ৭০ শতাংশ সুখা অঞ্চল বলে ধরা হয়। অনেকে সর্দার সরোবর প্রকল্পের সাফল্যের কথা বলেন, কিন্তু এই প্রকল্পের দ্বারা খুব বেশি জমি উপকৃত হয়নি। প্রকল্পটি সম্পূর্ণও হয়নি। অন্য দিকে, নলকূপ সেচের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভে জলস্তর খুবই নেমে গিয়েছে। সেই কারণে, নব্বইয়ের দশকে তৃণমূল স্তরের বিভিন্ন সংগঠনের সাহায্যে রাজ্যের কৃষককুল তিন ধরনের সেচের দিকে ঝুঁকে পড়ে চেক ড্যাম, গ্রামীণ পুকুর ও বোরি বন্দ। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এসে স্লোগান তোলেন ‘চেক ড্যাম, চেক ড্যাম গুজরাত’ (কংগ্রেসের ‘চক দে, চক দে গুজরাত’-এর বিপরীতে)। চেক ড্যাম হল, নদী ও খালগুলিকে অসংখ্য ছোট ছোট ‘সাময়িক’ বাঁধ দিয়ে বেঁধে ফেলা। কাঁচা বাঁধগুলি নদীর গতিকে রোধ করার ফলে অবরুদ্ধ জলকে চাষের জমিতে গড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। ফল: ২০০০-০১ থেকে ২০০৭-০৮-এর মধ্যে গুজরাতে কৃষিক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ৯.৬ শতাংশ, যা এক সর্বকালীন রেকর্ড এবং যা কিনা সবুজ বিপ্লবের সময়ে পঞ্জাবেও ঘটেনি। এই নরেন্দ্র মোদী ও এই গুজরাত কিন্তু মিডিয়ার নজরে পড়েনি, মিডিয়া ব্যস্ত থেকেছে নগর নিয়ে। জমিতে জল প্রবেশের ফলে শুধু গম নয়, বিভিন্ন তৈলবীজ, আলু, কলা ও আম জাতীয় বাণিজ্যিক ফসল ও ফলের ফসলও বাড়ল। দেশের উদার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কৃষিতে বাণিজ্যিকীকরণ বাড়তে লাগল। ভাল বীজের কল্যাণে বাড়ল বিটি তুলোর উত্পাদনও। এ সব কারণে কৃষিপণ্যের রফতানি বাড়ল। আর বাড়ল গ্রামে মোদীর ভোট-ব্যাঙ্ক।
গ্রামে মোদী আরও দু’টি বিষয় সুনিশ্চিত করলেন। তা হল, পাকা রাস্তা ও নিয়মিত উত্কৃষ্ট মানের বিদ্যুত্। বিশেষ করে, ভোল্টেজ ঠিক রাখার ফলে চাষিদের পাম্পসেটগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো গেল, আবার বিদ্যুত্ সরবরাহের ফলে গ্রামীণ অ-কৃষিক্ষেত্রেরও বিস্তার ঘটল। তবে, গুজরাতের গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত্ ছড়িয়ে দেওয়া গেলেও, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার একটি রিপোর্ট (২০০৫-০৬) বলছে, গ্রামীণ ছোট কারখানাগুলিকে উজ্জীবিত করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের মতো গুজরাতকেও বিদ্যুত্ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। তবু, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার অন্যান্য রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে বলাই যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ ছোট কারখানার সংখ্যা গুজরাতের চাইতে অনেক বেশি হলেও, গুজরাতে (গ্রামীণ) ছোট কারখানা পিছু বার্ষিক মোট যুক্তমূল্যের (ভ্যালু অ্যাডেড) পরিমাণ পশ্চিমবঙ্গের চাইতে অনেক বেশি। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামীণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশার ফসল, অর্থাত্ গ্রামের দরিদ্র মানুষ নিরুপায় হয়ে বিকল্প আয়ের সন্ধানে কিছু একটা খুলে বসেছেন; অন্য দিকে, গুজরাতের গ্রামীণ ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার ফসল, অর্থাত্, গ্রামীণ মানুষ আয়বৃদ্ধির ফলে অ-কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগ করছেন। এর পরেও কি মনে হয় যে গ্রামীণ গুজরাত ডুবছে?
আমদাবাদে সর্দার পটেল ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ-এ অর্থনীতির শিক্ষক।