প্রসিদ্ধ শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন-এর সহিত কলিকাতার ভঙ্গুর উড়ালপুলের সংযোগ ‘ছিল’ কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু চলমান সপ্তাহের পর সেই সংযোগ একেবারে প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত ‘হইয়া গেল’। আপাতত দুইটি বিষয়ই ওতপ্রোত ভাবে জড়িত হইয়াছে অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির সহিত। মজার ব্যাপার, যে প্রশ্ন তুলিয়া শাসক দলের চেলাচামুন্ডারা হুজ্জতি করিতেছেন, তাঁহাদের হুজ্জতিই সেই প্রশ্নের উত্তর দিতেছে। এমন দৃষ্টান্ত কমই দেখা যায়। কলিকাতার অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এর কর্মচারী ইউনিয়নের তৃণমূল কংগ্রেস-চালিত নেতা সন্তোষ দাস সম্ভবত বোঝেন নাই যে নিজেদের সর্বনাশ তাঁহারা নিজেরাই করিতেছেন। কেন উড়ালপুল বিপর্যয় সংক্রান্ত ভিডিয়ো দেখানো হইবে বলিয়া পুলিশ ডাকিয়া ধুন্ধুমার হাঁকিয়া তাঁহারা হাতেনাতে বুঝাইয়া দিতেছেন যে ভিডিয়োটি কতটাই জরুরি ও প্রাসঙ্গিক ছিল! শিল্পী সনাতন দিন্দা ঠিক কী বক্তব্য প্রকাশ করিতে চাহিয়াছিলেন, আপাতত তাহা আর বিচার্য নয়। একদা তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ এই শিল্পীর সহিত সরকারের বর্তমান সম্পর্ক কী, ইহাও প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন একটিই। দলমতনির্বিশেষে শিল্প ও শিল্পীর উপর কী ভাবে এ হেন সরকারি হামলা ঘটিতে পারে? বিশেষত যখন প্রতিষ্ঠানটি কোনও মতেই ‘সরকারি’ নয়? তর্কের খাতিরে যদি ধরিয়াও লওয়া হয় যে, এই বিশেষ ক্ষেত্রে শিল্পীর উদ্দেশ্যই ছিল সরকার বা প্রশাসনের সমালোচনা, তাহাতেও কি এই হামলার সমর্থন রচনা সম্ভব? তত্ত্ব আলোচনার দরকার নাই, সাধারণ বুদ্ধিই বলিয়া দেয়, কোনও জননির্বাচিত সরকারের নাগরিক সমালোচনার বিরুদ্ধে এমন হামলা চালাইবার অধিকার নাই। ইহা গণতন্ত্র নয়। স্রেফ গুন্ডাগিরি।
সাধারণ বুদ্ধি ইহাও বলিয়া দেয়: অতীত ইতিহাস দিয়া বর্তমান গুন্ডামির ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয় না। গুন্ডামি গুন্ডামিই। প্রাক্তন বামফ্রন্ট সরকারও তো নাটক বন্ধ করিয়াছে, শিল্পের স্বাধীনতায় কত আঘাত হানিয়াছে ইত্যাদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সুলভ যুক্তি নেহাত বালখিল্যতা, কুযুক্তি, অন্যায় ও অনাচার পালনের সুবিধাজনক অজুহাত। বামফ্রন্ট অন্যায় ও অনাচার করিয়াছিল বলিয়াই তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস পাঁচ বৎসর আগে সেই সরকারের মূলোৎপাটন করিতে সমর্থ হয়। কিন্তু সেই নির্বাচনে বাম গুন্ডাগিরির মূল তুলিয়া তৃণমূল গুন্ডাগিরির আবাহন করিবার বাসনা রাজ্যবাসী পোষণ করেন নাই। সুতরাং অনর্গল ও অযৌক্তিক অতীত উদাহরণ দর্শানো বন্ধ করিয়া বঙ্গেশ্বরী এক বার নিভৃতে ভাবিয়া দেখিতে পারেন: জনগণ তাঁহার নিকট কী চাহিয়াছিলেন, আর কী পাইয়াছেন।
অবশ্য, যে নেত্রী ক্ষমতায় উন্নীত হইবার পরমুহূর্ত হইতে একের পর এক তীব্র অসহনের দৃষ্টান্ত স্থাপনে ব্যস্তসমস্ত থাকেন, কেনই বা তিনি এমন নিভৃত ভাবনা ভাবিবেন? আশ্চর্য তাঁহার ধারাবাহিকতা। চার বৎসর আগের একই দিনে, ১২ এপ্রিল, গ্রেফতার হইয়াছিলেন অম্বিকেশ মহাপাত্র। এই ১২ এপ্রিল পুলিশি হামলা হইল অ্যাকাডেমিতে। দুই ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র মাপের স্থানীয় নেতার ক্ষুদ্র অভিযোগেই মহামহিম ক্ষমতাপুলিশরা লাফাইয়া মঞ্চে অবতীর্ণ হইয়াছেন। অভিযোগের ভিত্তিটি তলাইয়া দেখিবার সময়টি পর্যন্ত পান নাই, তাহার আগেই ‘অ্যাকশন’। দুই ক্ষেত্রেই নাগরিকের ন্যায্য সমালোচনার অধিকারে সন্ত্রস্ত সরকার অকারণ আক্রমণাত্মক। এত ভয়, এত নিরাপত্তাবোধের অভাব, এত অসহনশীলতা ঠিক স্বাভাবিক নয়। এই অস্বাভাবিক মনোবিকার লইয়া গণতান্ত্রিক শাসন চালানো অসম্ভব। সনাতন দিন্দা এবং তাঁহার মতো বহু পশ্চিমবঙ্গবাসী এক দিন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করিয়া অগণতন্ত্রকে সমর্থন করিয়াছিলেন। আজ সেই সামূহিক ভ্রান্তির মূল্য চুকাইতে হইতেছে।