এক জন শিক্ষক হিসেবে বহু আলোচনাসভা বা কর্মশালায় যেতে হয়। সারা দিনের একঘেয়েমি একতরফা বকবক, দিনের শেষে একটা প্যাকেট বা ব্যাগ-হাতে ফেরার সময় হাতে পেনসিলটুকুও থাকে না। যা থাকে, তা হল, ঝোলাভর্তি বিরক্তি।
অথচ এই কর্মশালাগুলি সামাজিক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কতটা দরকারি ভূমিকা পালন করতে পারে, তার প্রমাণ মিলল কিছু দিন আগে, প্রতীচী ইনস্টিটিউট আয়োজিত গণ-আলোচনাসভায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে। কয়েক বছর ধরেই প্রতীচী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাম্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে প্রতি বছর কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। গতে বাঁধা আলোচনাসভার থেকে এর পার্থক্য হল, এখানে শ্রোতারা যেমন শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে সরকারি আমলারাও, তেমনই তাঁরাই বক্তাও।
প্রতিটি মানুষেরই তার পাশের মানুষটির থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। সব বিষয়েই যে সকলে সহমত হবেন তা নয়, কিন্তু অনেক না-জানা বিষয়ও এ ভাবেই জানা হয়ে যেতে থাকে। আমরা অনেক কিছুই জানি বা বুঝি, কিন্তু তার বেশির ভাগটাই মুখস্থবিদ্যার মতো। প্রয়োগ হয় না। তাই শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও তার ব্যবহার হয় না, পড়ে থাকে। বিষয়গুলি নিয়ে পারস্পরিক আলোচনা একটা বোধ গড়ে তোলে, যা ধরাবাঁধা বক্তৃতায় উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাই উত্তর দিনাজপুরের তপন প্রামাণিকের কথা সবাই মন দিয়ে শোনেন, কারণ তাঁরা শৌচাগার ব্যবহারের প্রয়োজন বিষয়ক চেতনা স্কুলের চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ না রেখে গ্রামের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেও সক্রিয়; সে কাজ তাঁরা করছেন স্কুলের ছেলেমেয়েদের দিয়েই। মুর্শিদাবাদের দরিদ্র একটি গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী নাজমা নাসিমার কথাও মনে পড়ে যায়। প্রথম যখন তিনি এই কেন্দ্রে আসেন, তখন সেখানে বেশ ক’জন অপুষ্ট শিশু। আবার ওঙ্গনওয়াড়ির যা বরাদ্দ, বাজার অনুযায়ী পেট ভরানোর চেষ্টা চললেও পুষ্টি পর্যাপ্ত হয় না। নাজমা গ্রামের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে মায়েদের সঙ্গে কথা বললেন। বোঝালেন, ঘরের রান্নার শেষে পড়ে থাকা এক টুকরো কুমড়োও তাঁদের বাচ্চার পুষ্টির জন্য কতটা জরুরি। যদি গ্রামের প্রতিটি মা রান্নার পর পড়ে থাকা সামান্য সব্জির টুকরোটাও কেন্দ্রে দিয়ে যান, ওই খিচুড়িই পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়ে উঠবে। এর পর থেকে পালা করে দশ জন বাচ্চার মা প্রতিদিন যা সব্জি দিয়ে যেতে লাগলেন, তাতে কেন্দ্রে খাবারের পুষ্টিগত মান নিয়ে আর কোনও প্রশ্নই থাকল না। নাজমা আজ গর্ব করে বলেন, তাঁর কেন্দ্রে আর অতি-অপুষ্ট বাচ্চা একটিও নেই।
সরকারি জটিলতা বা না-পাওয়ার হিসেব তো প্রচুর। কিন্তু তার মধ্যেও কোথাও কোথাও এ ভাবেই শিক্ষক বা স্বাস্থ্যকর্মী বা অন্যান্যদের উদ্যোগে সমস্যাগুলিকে সমাধান করার যে চেষ্টা চলছে, তা সত্যিই শিক্ষণীয়। এই ব্যক্তিগত উদ্যোগগুলি গ্রামের মানুষকেও এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলিতে যে নানা কর্মযজ্ঞ চলছে, তা এই কর্মশালায় না এলে জানতেই পারতাম না।
এ রকমই আরও অনেক ছোট ছোট অভিজ্ঞতার কথা শিক্ষক, অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী ও অন্যান্যরা যে দু’দিন ধরে বর্ণনা করলেন। ভাল অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে খারাপ পরিস্থিতির কথাও যেমন এল, তেমনই খারাপ পরিস্থিতিতেও কতটা ভাল থাকা যায়, তার সমাধানও খুঁজে পাওয়া গেল। কারণ, ওঁরা সকলেই জানেন যে এগোতে হবে, নেই বলে থেমে থাকলে চলবে না।
কর্মশালায় অভিভাবকবৃন্দ ও অন্যান্যদের মতো অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী, অশোকেন্দু সেনগুপ্তও সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনলেন ও তাঁদের মতামত জানালেন। এবং বসে শুনলেন অমর্ত্য সেন প্রতি বছরের মতোই সময়ের অনটনের মধ্যেও সময় বার করে হাজির লোকজন কী ভাবছেন, কী করতে চাইছেন, সে-সব জানার বিপুল আগ্রহে। আরও এক বার তাঁকে জানা হল। তাঁর পাণ্ডিত্যের উৎসটা শুধু তাঁর প্রখর মস্তিষ্ক নয়, বিরাট এক মন যে-মন বলা ও করা, চিন্তা ও অনুশীলনের একত্র সাধনের দিকে আকৃষ্ট করে।