সর্বজয়ার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল।’ কারণ, মনসাপোতা গ্রামে একাকিনী সর্বজয়াকে আমৃত্যু বাস করতে হবে। জলপানি-পাওয়া অপুকে পিছু টেনে মনসাপোতায় যজমানিতে আবদ্ধ রাখার শক্তি সর্বজয়ার ছিল না। সারা পৃথিবীরও নেই। গ্রাম ভেঙে, পরিবার ভেঙে কাজের জন্য, শিক্ষার জন্য মানুষ ছড়িয়ে যাচ্ছে আবিশ্ব। পড়ে থাকছে নিশ্চিন্দিপুরের পোড়ো ভিটা, ইন্দির ঠাকরুনেরা, সর্বজয়ারা। গ্রামসমাজ আর অপুদের ধরে রাখতে পারেনি। সেই ধারাই চলবে, আরও পুষ্ট হবে। ২০১১ সালের জনগণনা বলছে, সারা দেশে যে ২৪ কোটি ৮৮ লক্ষ পরিবার গণনায় এসেছে, তার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ পরিবারে ৬০ বছরের বেশি বয়সের কোনও মানুষ নেই, কারণ তাঁরা রয়ে গেছেন তাঁদের পুরনো বাড়িতে। একলা, নয়তো শুধু বুড়োবুড়ি একে অপরকে জড়িয়ে বাঁচা। ছেলেমেয়ে থেকেও নেই, অন্যত্র চলে গেছে কাজের খোঁজে, পড়তে, বিয়ে করে। দু’তরফেই মতামত জোরালো, তাই স্বতন্ত্র ভাবে থাকতে চাওয়া সন্তান পূর্বপ্রজন্মের সঙ্গে এক ছাদের তলায় থাকতে স্বস্তি পায় না। যে সমস্ত একলা মানুষ পিছনে রয়ে গেলেন তাঁদের মধ্যে প্রায় তিন জনে দু’জন মহিলা। মেয়েদের আয়ু বাড়ছে, বিধবাদের সংখ্যা বাড়বেই। বাকিরা বিবাহবিচ্ছিন্না, স্বামী-পরিত্যক্তা বা অবিবাহিতা। এ নিয়ে হাহুতাশ করব, না কি নিজেদের তৈরি করব? জলপানি-পাওয়া অপুকে পিছু টেনে মনসাপোতায় যজমানিতে ধরে রাখতে চাইলে কি আমরা সর্বজয়াকে সমর্থন করি?
আমাদের দেশে গড়ে ষাটোর্ধ্ব তিন জনে দু’জন মেয়েকেই ধরে নিতে হবে তাঁকে একলাই জীবনটা কাটাতে হবে। শহরাঞ্চলে হয়তো অনুপাতটা কম হবে, কিন্তু শহরের থেকে গ্রামেই বেশি একলা মেয়ে থাকবেন, যেমন এই জনগণনা দেখিয়েছে ওই ষাটোর্ধ্ব একলা মেয়েদের ১৭ শতাংশ শহরে থাকেন। আমাদের দেশে মেয়েদের বিয়ে হবেই, যদি না হয়ে থাকে, যদি সে বিয়ে না টিকে থাকে, সে সবই মেয়েদের দোষ। আর মেয়েদের দোষ যদি চোখে না দেখা গেল, তা তার কপালের দোষ। বিধবা, বিবাহবিচ্ছিন্না, স্বামী-পরিত্যক্তা বা অবিবাহিতা মেয়ে ‘অপয়া’, পরিবারে স্বীকৃতি নেই, সম্পত্তির, সাজগোজের, অবসরের, পারিবারিক অনুষ্ঠানে সমান তালে অংশ নেওয়ার অধিকার নেই। এমনকী স্বামীর বা বাবার সম্পত্তি থাকলেও সে মেয়ে দেওরের বা ভাইয়ের পরিবারে থাকতে বাধ্য হলে মুখ বুজে খেটে যাবেন, নিজেকে আড়ালে রাখবেন, আর তাঁর চলনবলনের উপর আজীবন আমরণ থাকবে হাজারো নজরদারি। বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার বাইরে থাকেন যে-সব মেয়ে, তাঁরা সবাই আমাদের সমাজে ‘ব্যর্থ’ বলে গণ্য, কারণ তাঁরা বিয়ে করে সংসার-সন্তান (পুত্র হলে আরও ভাল) নিয়ে ফুলে-ফলে ভরে উঠতে পারেননি। স্বামীকে হারালে বা স্বামী ছেড়ে গেলে সেটা নিশ্চয়ই তাঁর বা তাঁর কপালের দোষ। সে মেয়ে কোনও অশান্তির বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে এলে সে সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। সমস্তরের পাত্র বা পর্যাপ্ত পণের টাকা জোগাড় করা গেল না বলে যে-মেয়ের বিয়ে হল না বা যে-মেয়ে বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁদের আমাদের সমাজ এখনও নিন্দা আর কৌতূহলের চোখেই দেখে, চলে সতর্ক নজরদারি। এই আচরণকে গ্রাম্য বললে খুব ভুল হবে, শহুরে, মধ্যবিত্ত আবহে, এমনকী ফ্ল্যাট-কালচারেও এ ধরনের ভাবনার নিয়ত আনাগোনা। এই ‘অপয়া’ একলা মেয়েরাই নৈঃশব্দের দেওয়াল ভেঙে এগিয়ে আসছেন, তাঁদের একাকিত্বকে যে সমাজ দুর্ভাগ্য বলে ছাপ্পা মেরেছে, তার নৈতিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন।
সর্বজয়ারা দল বাঁধছেন
শুরুটা হয়েছিল এনজিও’দের উদ্যোগে, রাজস্থানে। ২০০০ সালে উদয়পুরে এক নারী শক্তি সংগঠন তৈরি হয় ১০০ দিনের কাজে একলা মেয়েদের হক আদায়ের দাবি থেকে। সেই কাজ পরিবার হিসেবে দেওয়া হত। একলা মেয়েদেরই আগে কাজ দরকার, পরিবারে ভরণপোষণের কোনও পুরুষ নেই বলে। অথচ একলা মেয়েরা পরিবারের হিসেব থেকে বাদ পড়ে যেতেন। সেই সঙ্গে মেয়েদের বেহাত হওয়া জমির দাবি বুঝে নেওয়া, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের খবর দেওয়া—এ সব কিছুর মধ্যে দিয়ে একলা মেয়েদের সংগঠন ছড়িয়েছে। তার পর ঝাড়খণ্ডে এই সংগঠন ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারতে আসা হিংস্র জনতার কবল থেকে একলা মেয়েদের বাঁচিয়েছে, গুজরাতে মেয়েদের পড়াশোনা ফের শুরু করাতে সাহায্য করেছে। আর সবাইকে আইনি আর অধিকারের প্রাথমিক পাঠ দিয়েছে, পুলিশ আর আদালতে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পাশে দাঁড়িয়েছে, বিপিএলের কার্ড করাতে, ১০০ দিনের কাজের জব কার্ড করাতে বা সমান মজুরি না মিললে, পাওনাগন্ডায় ফাঁকি পড়লে তা বুঝে নিতে নিয়মকানুন শিখিয়েছে। আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। দেখা গেছে, একলা মায়ের সন্তানরা বেশি দরিদ্র হয়, তাই আজ ১৪টি রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা এই সংগঠন দাবি করছে আরও বেশি প্রকল্প বিশেষ ভাবে বিধবা ও অন্য একলা মেয়েদের ও তাঁদের সন্তানদের জন্য বরাদ্দ হোক। সেই সঙ্গে তাঁরা চাইছেন ভাগ্যহীনা বলে চিহ্নিত হওয়া বন্ধ করতে, দল বাঁধছেন রাজনৈতিক নেতাদের সমঝে দেওয়ার মতো শক্তি অর্জন করতে। সংগঠন তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখনও তাঁরা সামাজিক অনুষ্ঠানে সম্মান পান না, আর সে-সব অনুষ্ঠানে পুরুষরা পরিবারের মেয়ে-বউদের এঁদের সঙ্গে মেশা থেকে আগলে রাখেন, পাছে তাঁদের পরিবারের মেয়েরাও আবার অধিকারের দাবি জানাতে শুরু করে! পশ্চিমবঙ্গে একলা মেয়েদের সংগঠন তৈরি হয়েছে বলে এখনও জানি না, তবে আমাদের বিধবাদের পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যাওয়ার জন্য কাশী-বৃন্দাবন, নিদেনপক্ষে নবদ্বীপ তো রয়েইছে।
এক দশকেরও বেশি আগে এ দেশে ৩ কোটি ৬৬ লক্ষ মেয়ে বিধবা, বিচ্ছিন্না বা পরিত্যক্তা ছিলেন, এ বিষয়ে সাম্প্রতিক তথ্য এখনও আসেনি। কিন্তু অভিজ্ঞরা বলেন, এই তথ্যের থেকে অনেক বেশি মেয়ে আছেন এই দলে, কারণ বহু ক্ষেত্রে জানলেও সম্মানহানির ভয়ে পরিত্যাগ বা বিচ্ছেদের কথা পরিবার স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু এ ধরনের পরিবার যে অনেক বেশি দরিদ্র, সমস্ত গবেষণা সে কথা জোর দিয়ে বলেছে। তাই একলা মেয়েদের অধিকারের বিষয়টি শুধু এনজিও’দের হাতে ছেড়ে রাখলে চলবে কি?
জনবিন্যাসে বয়সের কাঠামো বদল, মেয়েদের প্রত্যাশিত আয়ু বাড়া, দেশের মধ্যে দেশান্তরী হওয়ার প্রবণতা বাড়া—এ সবই আমাদের দেশে একলা মেয়েদের সংখ্যা বাড়াবে। এঁদের মধ্যে যাঁরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সামর্থ্য রাখেন, তাঁরা তো অনেকটাই বেঁচে গেলেন। তাই বৃদ্ধাশ্রমের নামে হাহুতাশ না করে কী করে এই মেয়েদের, বিশেষ করে ষাটোর্ধ্বদের মাথা উঁচু করে বাঁচার ব্যবস্থা করা যায়, সেটা তো সরকারকেও ভাবতে হবে।