যে আর ফিরবে না, তাকে যেতে দাও।— কথাটা যত সহজ, ততই কঠিন। এক দিন যেতেই হবে, সবাই জানে। কিন্তু যাওয়ার সময় কখন এল, বলে দেবে কে? এক বলতে পারেন চিকিত্সক। এক সময় অসঙ্কোচে সে দায়িত্ব তাঁরা নিতেনও। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাসে জীবন মশায় যেমন মতির মাকে দেখে ওষুধ দিতে রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘দুঃখ কীসের গো, নাতিপুতি ছেলেবউ রেখে ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবে।’ নিজের জীবনান্তেও বৃদ্ধ কবিরাজ ঘুমের ওষুধ খাননি। মৃত্যুর রূপ, স্বর, গন্ধ, অনুভব করতে চেয়েছেন। এগিয়ে গিয়ে মাননীয় অতিথির অভ্যর্থনার মতো, কখনও তুলসীতলায়, কখনও নদীর ঘাটে অন্তর্জলি করে প্রতীক্ষা তো রীতিই ছিল। মহাকাব্যের নায়করা আবার অপেক্ষাও করেননি, মৃত্যুর খোঁজে বেরিয়েছিলেন পায়ে হেঁটে। মহাপ্রস্থানে যাওয়া মনস্থির করে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বলছেন, ‘কালপাশমহং মন্যে ত্বমপি দ্রষ্টুমর্হসি’ (কালের কবলে আমিও পড়ব, তুমি কর্তব্য স্থির করো)।
সে কর্তব্য স্থির করা কত কঠিন, স্পষ্ট হয় যে কোনও হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ঢুকলে। বহু টিউবে আকীর্ণ দেহ, উঠছে-নামছে ভেন্টিলেটরের ব্যাগ, নানা মনিটরে প্রত্যঙ্গের ছন্দরেখা। এক ক্রিটিকাল কেয়ার বিশেষজ্ঞের আন্দাজ, আইসিইউ-এর রোগীদের ২০-৩০ শতাংশই মাস ছয়েকের বেশি বাঁচবেন না, প্রায় ১০ শতাংশের আর আশা নেই। কিন্তু নাছোড় বহু পরিবার। এক সার্জেন বললেন, ৪৬ বছরের এক রোগী অ্যাকিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস হয়ে প্রায় দু’মাস ভর্তি ছিলেন। পর পর চার বার অপারেশন করে প্যানক্রিয়াসের আরও, আরও একটু অংশ বাদ দিতে হয়েছে। শেষ দশ-বারো দিন আশা নেই জেনেও ডায়ালিসিস, ভেন্টিলেশন চলেছে। ওষুধে আচ্ছন্ন মানুষটি শেষে ইঙ্গিতে কাগজ-কলম চেয়ে লিখলেন, ‘নো মোর।’
এমন ইচ্ছেকে সম্মান করতে হয় চুপিসাড়ে। এ দেশে আইন এখনও ডাক্তারদের সে অধিকার দেয় না। সম্প্রতি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এ ‘চিকিত্সা ও আইন’ বিষয়ে একটি দু’দিনের আলোচনা সভায় ডাক্তাররা আক্ষেপ করলেন, রোগীর জীবনযন্ত্রণা না বাড়িয়ে মুক্তি দিতে চাইলে আইনের চোখে তা ‘আত্মহত্যায় সহায়তা’ বলে গণ্য হবে। কোন অবস্থায় রোগী পৌঁছে গেলে আর তার শ্বাস ফিরিয়ে আনা আর উচিত নয়, তা নিয়ে ১৯৮৬ সাল থেকেই নানা দেশে বিধি তৈরি হয়েছে। ভারতে আজও আইন-বিধি, কিছুই হয়নি। এমনকী মৃতকেও মরতে দেওয়া যায় না। ডাক্তার সন্দীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, যার মস্তিষ্ক আর কাজ করছে না, সে ‘ব্রেন ডেড’ নয়, সে ‘ডেড’ — মৃত। ‘লাইফ সাপোর্ট’ না বলে বলা দরকার ‘কৃত্রিম শ্বাস।’ আমাদের ভাষা ভ্রান্ত, চিন্তা ভুল। মৃত্যু কী, আমরা বুঝি না।
মৃত্যু কী, কখন বলা চলে ‘মরে গিয়েছে’, এ সব ধোঁয়াটে প্রশ্নের সঙ্গে জুড়ে যায় হাসপাতালের বিলের নেহাত কেজো প্রশ্ন। পরশু যে হাউমাউ করে কেঁদে বলেছিল, “ডাক্তারবাবু বাড়িজমি বিক্রি করে দেব, মাকে বাঁচান,” চার দিন পরে আড়াই লক্ষ টাকার বিল হাতে পেয়ে সে-ই সন্দেহ করে, বিল বাড়াতে মাকে রাখা হয়েছে আইসিইউতে। ক্রিটিকাল কেয়ার চালাতে গিয়ে ঋণে ডুবতে হয়েছে, এমন পরিবার কম নয়। যেখানে টাকা দিচ্ছে রাষ্ট্র, সেখানে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নও ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘মেডিকেয়ার’-এর ২৫ শতাংশ টাকা খরচ হয় মাত্র ৫ শতাংশ রোগীর জন্য, যাঁরা জীবনের শেষ বছরে রয়েছেন। ইউরোপের কিছু দেশের তথ্যও তাই বলছে।
এ কথাগুলো বুদ্ধিগ্রাহ্য বটে, তবে মনের কাছে ঠিক তেমন জুতসই ঠেকে না। আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে সেরা চিকিত্সা আমি দেব, সেটাই আমার কর্তব্য। সেখানে অত হিসেব আসে কোত্থেকে? এখন চিকিত্সায় প্রযুক্তি, ওষুধ, থেরাপি, সব কিছুর উন্নতি হয়েছে। মানুষটা বাঁচবে না, এটা ধরেই বা নেব কেন? ‘যেতে তো হবেই’ বলে হাল ছেড়ে দেওয়াই কি ডাক্তারের কাজ?
মরণাপন্ন রোগীর ক্ষেত্রে ডাক্তারের কর্তব্য কী, তা নিয়েই সম্প্রতি বস্টনের সার্জন অতুল গাওয়ান্ডে লিখেছেন বিয়িং মর্টাল বইটি। অ্যামাজন ওয়েবসাইটে পাঠকরা বইটিকে পাঁচে পাঁচ দিয়েছেন, হাজারেরও বেশি রিভিউ করেছেন। কী আছে বইটিতে? আছে গল্পের পর গল্প: রোগীর জীবনের শেষ দিনগুলোর দোলাচল, আর তার সামনে দাঁড়ানো ডাক্তারের দ্বিধাদ্বন্দ্বের।
সব গল্পের মধ্যে দিয়ে অতুল বলছেন, জীবনকে আরও একটু লম্বা করাই রোগীদের একমাত্র ইচ্ছা নয়। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রণা এড়ানো, পরিবার-বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করা, মন সজাগ রাখা, নিজেকে ‘বোঝা’ না করে তোলা, জীবনে পূর্ণতার বোধ আনা। “আমাদের প্রযুক্তি-প্রধান চিকিত্সা এই সব চাহিদা পূরণে ব্যর্থ,” লিখছেন অতুল। নিরাময়ের অযোগ্য অসুখে যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা ভাড়া-করা আইসিইউ, কৃত্রিম হাওয়া, ফ্লুরোসেন্ট আলোয় শেষ মুহূর্ত কাটাচ্ছেন। এক এক করে প্রতিটি প্রত্যঙ্গ কাজ বন্ধ করছে, চেতনা আচ্ছন্ন। ‘তা হলে চলি’, ‘ক্ষমা কোরো’ কিংবা ‘ভালবাসি’ বলে যাওয়ার সুযোগটুকু না পাওয়া, এই কি রোগীর কাম্য ছিল? এ ভাবে মরে যাওয়া কি একটা অপূর্ণতা নয়?
তা হলে বিকল্প? অতুল বলছেন ‘হসপিস কেয়ার’-এর কথা। যেখানে রোগীর তত্ত্বাবধানে ডাক্তারের সমান গুরুত্ব নার্স, সমাজকর্মীর। হাসপাতালের চিকিত্সায় রোগীর বর্তমান জীবনের মান অবনত করা হয়— সার্জারি, কেমোথেরাপি, ইনটেনসিভ কেয়ারে রাখার মতো ব্যবস্থা নিয়ে যাতে পরে জীবন উন্নত হয়। আর হসপিস কেয়ারের মন্ত্র: ‘লিভ ফর নাউ’ এখন বাঁচো। যন্ত্রণা এড়ানো, মন সজাগ রাখা, অভ্যস্ত জীবনযাত্রা বজায় রাখার জন্য দেওয়া হয় সহজে অ্যাডজাস্ট-যোগ্য বেড। ব্যথার ওষুধ দেওয়া হয় বেশি মাত্রায়। রোগীর পরিচর্যা বাড়ির লোককে শেখানো হয়। ইমার্জেন্সিতে কী করা দরকার, কাকে ডাকা দরকার, জানানো হয় তা-ও।
সমীক্ষা বলছে, হসপিস কেয়ারে রোগীদের জীবনকাল কমে না, বরং একটু বাড়ে। সাধারণ চিকিত্সাধীনের সঙ্গে তুলনায় স্তন ক্যান্সার, প্রস্টেট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সারের রোগীদের জীবনকালে পার্থক্য হয় না। বরং হসপিস কেয়ারে প্যানক্রিয়াস ক্যান্সারের রোগীরা গড়ে তিন সপ্তাহ, লাং ক্যান্সারের রোগীরা ছয় সপ্তাহ, হৃদরোগীরা তিন মাস পর্যন্ত বেশি বাঁচছেন। অতুল বলছেন, এ যেন ‘জেন’ দর্শন, আরও বেশি বাঁচার ইচ্ছে ছেড়ে দিলে তবেই বেশি বাঁচা যায়।
তবু কম লোকই হসপিস কেয়ারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অধিকাংশ চান, ডাক্তারই বলুন যে আর কিছু করার নেই। কিন্তু ডাক্তারের কিছুই করার নেই এমন প্রায় কখনওই হয় না, বলছেন অতুল। আরও চড়া ডোজে ওষুধ, নতুন, অপরীক্ষিত ওষুধ, আরও একটা অপারেশন, কিছু না কিছু করার থাকেই। একটার পর একটা উপায় বার করতে করতেই প্রাণ বের হয়ে যায়। তবে তা আচ্ছন্ন, নির্বান্ধব, অসহায় দশায়। সজ্ঞানে, স্বগৃহে নয়।
এক সময়ে ধর্ম জোগাত সহজে মৃত্যুকে গ্রহণের সূত্র। আজ বিজ্ঞান সেই চেষ্টা করছে।