উত্তমপুরুষ। গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণাটির প্রতি নেহরুর শ্রদ্ধা আজও অতুলনীয়।
একটা অদৃশ্য যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। জওহরলাল নেহরুর স্বত্বাধিকারের যুদ্ধ। আজই হতমান কংগ্রেস নেতারা তালকাটোরা স্টেডিয়ামে সনিয়া গাঁধীর নেতৃত্বে শপথ নেবেন, নেহরুর পথে অবিচলিত থাকার শপথ। নরেন্দ্র মোদী কাল স্কুলে স্কুলে চালু করবেন ‘বাল স্বচ্ছতা বছর’, আগামী এক বছরের সরকারি নেহরু উত্সবের সূচনা হবে কাল থেকে।
জন্মের ১২৫ বছর পূর্ণ হওয়া বিশেষ কৃতিত্বের, নেহরু তেমন দাবি করতেন বলে মনে হয় না। বরং, মৃত্যুর অর্ধশতক পরেও যদি এক জন মানুষের ভাবনার ধারাগুলো প্রাসঙ্গিক থাকে, সেটা অনেক বেশি তাত্পর্যপূর্ণ। ২০১৪ সালে তাঁর মৃত্যুরও পঞ্চাশ বছর হল। তাঁর মৃত্যুর পর ভারতীয় রাজনীতি যে পথে গিয়েছে, জানলে খুশি হতেন না তিনি। এক প্রধানমন্ত্রী দেড় বছরেরও বেশি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন; আর এক প্রধানমন্ত্রী এক দিকে বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়েছিলেন রামলালার উপাসকদের জন্য, আর অন্য দিকে মুসলমান মহিলাদের আরও বেশি ঠেলে দিয়েছিলেন মোল্লাতন্ত্রের জঠরে; তারও পরে এক প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম-নিধনের ব্যাখ্যা শুনিয়েছিলেন নিউটনের গতিসূত্র মেনে। নেহরু শিউরে উঠতেন রাজনীতির এই আহ্নিক গতি দেখে। ভারত এবং তার রাজনীতি কী হতে পারত, অথচ কী হল, এই দুইয়ের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান, সেটা দেখিয়ে দেওয়াতেই আজ নেহরুর প্রাসঙ্গিকতা।
প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতি মাসে দু’বার চিঠি লেখার যে রীতি নেহরু চালু করেছিলেন, এবং বজায় রেখেছিলেন আমৃত্যু, সেটা তাঁর মনের একটা জানালা। দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো সম্বন্ধেই হোক, অথবা সংখ্যালঘু মানুষের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়াই হোক অথবা আন্তর্জাতিক কোনও পরিস্থিতি, নেহরুর এই পত্রাবলি থেকে তাঁর চিন্তার স্পষ্ট দার্শনিক রূপরেখা মেলে।
সেই দর্শন সমদর্শিতার। সমদর্শিতায় বিশ্বাসী হওয়া মানে, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থার মূল্যায়নে নিষ্পক্ষ হওয়া, অন্যদের স্বার্থ এবং সমস্যার কথা খেয়াল রাখা; বিশেষ করে নিজের কায়েমি স্বার্থ, অগ্রাধিকার, অযৌক্তিক চিন্তা বা অপ্রমাণিত সংস্কার দ্বারা প্রভাবিত না হওয়া। আরও একটু ভেঙে বললে, কোনও এক জনের প্রতি কর্তব্য স্থির করার সময় নিজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অন্য সব পরিচয়ের কথা ভুলে গিয়ে নিজেকে একেবারে সেই মানুষটির জায়গায় নিয়ে গিয়ে ভাবা আমার প্রতি এই অবস্থায় কোন আচরণ প্রত্যাশা করব? এবং, সেই প্রশ্নের সত্ উত্তর খুঁজে ঠিক সেই আচরণটিই করা। অর্থাত্, ন্যায়ের প্রতি, ন্যায্যতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকা।
এমন দর্শনে বিশ্বাসী হওয়া এক কথা, আর নিজে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিপতি হয়েও নিজেকে এই দর্শনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকার কথা প্রতি দিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া আর এক। অবশ্য, যিনি ১৯৩৭ সালে নিজেই চাণক্য ছদ্মনামে কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে নিজের আচরণের সম্বন্ধে কঠোরতম প্রবন্ধে লিখতে পারেন, ‘লোকটা চায় কী? তার মুখোশের আড়ালে কী আছে, ক্ষমতার প্রতি কোন অদম্য আকর্ষণ? লোকটার দম্ভ এখনই মারাত্মক। একে সংযত করা প্রয়োজন’, এবং লেখাটি ছাপাতে পারেন বহুলপ্রচলিত কাগজে, তাঁর পক্ষে সম্ভব ন্যায্যতার ধারণার প্রতি এই অবিচলতা।
দেশভাগের পর ভারতীয় মুসলমানদের থেকে ভারতের প্রতি আনুগত্য আদায়ের যে রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছিল, তার নিন্দা করে ১৯৫০ সালের মার্চে নেহরু মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্দেশে লিখছেন, ‘ভয় দেখিয়ে বা হুকুম করে আনুগত্য আদায় করা যায় না। এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে হয়, যাতে আনুগত্য ভিতর থেকে আসে।’ এই চিঠির সাড়ে তিন বছর পরে, ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি লিখছেন, ‘যেখানে ‘আনুগত্য’ শব্দটির একমাত্র অর্থ হল সবাইকে আমার মতে চলতে হবে, সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের তরফে সংখ্যালঘুর কাছে আনুগত্য দাবি করার মতো অনুচিত আর কিছু হয় না।’ সেই চিঠিতেই আরও লিখেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠরা যদি সংখ্যালঘুদের ওপর নিজেদের জোর করে আরোপ করতে থাকে, তাতে শুধু সংঘাতই বাড়বে। ভারতকে প্রকৃত অর্থে সংহত করতে হবে সবাইকে মানসিক সংহতির সূত্রে বাঁধতে হবে।’
ঠিক কোন সময়ে দাঁড়িয়ে নেহরু এই কথাগুলো লিখছেন, সেটা খেয়াল করলে কথাগুলোর তাত্পর্য, এবং অপেক্ষাকৃত অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকা মানুষের প্রতি নেহরুর প্রশ্নাতীত সমদর্শিতা বুঝতে হয়তো সুবিধা হবে। পশ্চিম সীমান্তে দেশভাগ বহন করেছে অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক হিংসার বোঝা, আর পূর্ব পাকিস্তানে একের পর এক ঘটনায় সন্ত্রস্ত মানুষ, যাঁদের মধ্যে মুসলমান থাকলেও হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সর্বস্বান্ত হয়ে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতি দিন চলে আসছেন ভারতে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন প্রায় ৬৪ লক্ষ হিন্দু। দেশ জুড়ে দাবি উঠছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার, নিদেনপক্ষে এ পারের মুসলমানদের দেশত্যাগে বাধ্য করানোর। ঠিক এই সময়েই নেহরু এক দিকে জোর দিয়েছেন নির্বাচন করানোর ওপর, তা-ও দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ভোটাধিকার দিয়ে, আর অন্য দিকে প্রশ্ন করেছেন, ‘কেন প্রতি মাসে তিন থেকে চার হাজার মুসলমানকে ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হচ্ছে? কোনও ভয় বা চাপ না থাকলে তাঁরা যেতেন না। এটা আমাদের পক্ষে নিতান্ত অগৌরবের কথা’। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পাকিস্তানের সরকার সে দেশের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে, সেটা ভারতে সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণের মাপকাঠি হতে পারে না। ‘সংখ্যালঘুদের প্রতি ন্যায্য, এমনকী তারও অতিরিক্ত আচরণের মাধ্যমে তাঁদের আস্থা অর্জন সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তব্য।’
আজকের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এই অবস্থানকে ‘মুসলমান তোষণ’ বলে চিহ্নিত করবে। সমদর্শিতার যে শিখরে নেহরু দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই উচ্চতা সাধারণের পক্ষে অলঙ্ঘ্য। অতএব, নেহরু কেন লেখেন ‘গণতন্ত্রে শেষ অবধি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতই গ্রাহ্য হয়। সেই কারণেই, সংখ্যালঘুর প্রতি শুধু ন্যায়বিধান নয়, তাঁদের আস্থা অর্জনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠকে চেষ্টা করতে হবে’ সেটা এই সাধারণ রাজনীতিকদের কাছে অবোধ্য ঠেকবেই। বলে রাখা ভাল, নেহরু এ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু বলতে শুধু মুসলমানদের নয়, সব ধর্মীয়, ভাষাগত ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর কথা বলেছিলেন।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রতি নিজের বিতৃষ্ণা গোপন করেননি নেহরু। অথচ, ১৯৪৭ সালে তিনি মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্দেশে লিখেছিলেন, ‘আর এস এস নিশ্চিত ভাবে, এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলির বিরোধিতা করে। কিন্তু এটাকে তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের যথেষ্ট কারণ বলে বিবেচনা করবেন না। যে কোনও বৈধ প্রচার যেন চলতে দেওয়া হয়।’ বস্তুত, রাজনৈতিক পরিসরে ভিন্ন স্বর তৈরি হলে, তা সে স্বর যতই আক্রমণাত্মক হোক, তার বিরুদ্ধে কোনও দমননীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নেহরু বার বার তীব্র অনীহা প্রকাশ করেছেন। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে তিনি লিখেছেন, ‘দমননীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এই নীতি এক বার ব্যবহার করলে তার প্রতি আসক্তি বাড়ে, এবং এটাই সব সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে দাঁড়ায়।’ অক্টোবরে লিখেছেন, ‘আজ আমরা যে পথে চলব, সেটাই ভবিষ্যতের প্রশাসনের চলার পথ তৈরি করে দেবে। আজ যদি আমরা অত্যন্ত ন্যায্য এবং জরুরি কারণেও রাষ্ট্রীয় দমন শক্তি প্রয়োগ করি, ভবিষ্যতে হয়তো একেবারে সামান্য কারণে, এমনকী নিতান্ত অকারণেও সেই নীতি প্রযুক্ত হবে।’ যে সময়ে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী শক্তির উপস্থিতি একেবারে নগণ্য ছিল, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো উচ্চারণ করার অসাধারণত্ব চোখ এড়ানোর নয়। বিশেষত, ‘আমরা ২৩৫ এরা ৩০’-এর দম্ভ দেখতে অভ্যস্ত চোখ।
কী ভাবে সংবেদনশীল হতে হয়, ভারত নেহরুর কাছে তার দীক্ষা নিতে পারত। দুর্ভাগ্য, তাঁর লেখা চিঠিগুলো হয়তো রাজনীতিকরা উল্টেও দেখেননি। নয়তো তাঁদের চোখে পড়ত, ১৯৪৯ সালে নেহরু লিখেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলার তীব্র অবনতি ঠেকাতে পুলিশি ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি মানুষের অসন্তোষের কারণগুলো দূর করা, তাঁদের কাছে যাওয়া। দুর্ভাগ্য, আমাদের মধ্যে অনেকেই মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছি। ফলে, সাধারণ মানুষকে অতি সহজে যে কোনও বিক্ষোভে জড়িয়ে ফেলা যাচ্ছে। এই মানুষগুলোর সঙ্গে ফের সংযোগ গড়ে তোলা জরুরি। আমাদের সমস্যাগুলোর কথা তাঁদের বোঝাতে হবে, তাঁদের সক্রিয় সহযোগিতা চাইতে হবে।’ কেন মানুষ বিক্ষুব্ধ, সেই কারণের সন্ধান করে নিজের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করা সাধারণ কাজ নয়।
১৯৪৯ সালে নেহরু লিখছেন, ‘কমিউনিস্টদের কোনও নৈতিক মান নেই, এই দেশের উন্নতির জন্য কোনও ভাবনাও নেই। তবুও, অনেকেই আদর্শের টানে এই দলে যোগ দেন। তাঁদের গায়ের জোরে দমন করা যায় না। তাঁদের যদি হারাতে হয়, তবে সেটা শুধুমাত্র কোনও উচ্চতর আদর্শের মাধ্যমেই সম্ভব। কী ভাবে তাঁরা সেই আদর্শের জন্য কাজ করতে পারেন, তাঁদের সামনে সেই পথনির্দেশ দিতে হবে।’ বিরোধীর প্রতি এই সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা শিক্ষণীয়। বামপন্থীরা শেখেননি, অন্যরাও না।
অনগ্রসর শ্রেণি, জনজাতি অথবা ভাষাগত সংখ্যালঘু মানুষ, মহিলা যে কোনও অর্থে অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকা মানুষের কথা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর চিঠিতে। সমাজের বিবিধ অসাম্য, অস্থিরতার সুরাহা না হলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়, নেহরু বহু বার বলেছেন। বিশ্বাস করেছেন, ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে কোনও একটি প্রতিষ্ঠান বা কোনও এক জন মানুষের ওপর ভরসা করে বসে থাকলে হবে না। এগোতে হবে গণতন্ত্রের পরিসরে, আলোচনার মাধ্যমে, প্রত্যেকের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থানের কথা মাথায় রেখে।
দেশ শাসন করা আর দেশ গঠন করার মধ্যে যে পার্থক্য, উত্তরসূরিদের সঙ্গে নেহরুর মূলগত ফারাক সেখানে। অবশ্য, উত্তরসূরিরা শাসনের কাজটাও দক্ষ ভাবে করতে পেরেছেন বললে অতিকথন হবে। কিন্তু, তা ভিন্ন তর্ক।
ঋণ: লেটার ফর আ নেশন। সম্পা: মাধব খোসলা। পেঙ্গুইন অ্যালেন লেন