প্রবন্ধ ২

আমরা দেখি না বলেই তো আর মানুষগুলো মিথ্যে হয়ে যায় না

লাভলোকসানের অঙ্ক না কষে, ইনসেনটিভের তোয়াক্কা না করে প্রাণের টানে কাজ করছেন ওঁরা। মানুষ গড়ার কাজ। এই পশ্চিমবঙ্গে। চোখ খোলা রাখলেই দিব্য দেখা যায়। কুমার রাণাএমনটা সহজে চোখে পড়ে না। সুদৃশ্য স্কুল পশ্চিমবাংলায় অনেক দেখেছি; গাছগাছালির ছায়াশীতল অঙ্গন, ক্লাসে ক্লাসে শিশু ও শিক্ষকদের সহৃদয় পাঠচর্চা, পরিচ্ছন্ন প্রতিবেশ— এ সব মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। কিন্তু স্কুল চলাকালীন স্কুল চত্বরে মা-বাবা ও অন্য গ্রামবাসীদের সমাগম, যেটা নাকি কেরল-তামিলনাড়ুর বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেছি, এ রাজ্যে সেটা বিরল বললে অত্যুক্তি-দোষ ঘটে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share:

অন্য ছবি। পাইনালা মহাগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়।

এমনটা সহজে চোখে পড়ে না। সুদৃশ্য স্কুল পশ্চিমবাংলায় অনেক দেখেছি; গাছগাছালির ছায়াশীতল অঙ্গন, ক্লাসে ক্লাসে শিশু ও শিক্ষকদের সহৃদয় পাঠচর্চা, পরিচ্ছন্ন প্রতিবেশ— এ সব মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে। কিন্তু স্কুল চলাকালীন স্কুল চত্বরে মা-বাবা ও অন্য গ্রামবাসীদের সমাগম, যেটা নাকি কেরল-তামিলনাড়ুর বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেছি, এ রাজ্যে সেটা বিরল বললে অত্যুক্তি-দোষ ঘটে না। অতএব, এই মধ্যদিনে দক্ষিণ দিনাজপুরের অভ্যন্তরে পাইনালা মহাগ্রাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, ‘স্কুলের টানে’ এত জন নর-নারীর সমাবেশ বিস্মিত করবেই।

Advertisement

এমন নয় যে তাঁদের কাজকর্ম নেই। অর্থনৈতিক বামনত্ব তাঁদের জীবনে বিশ্রামের অবসর রাখেনি, কিন্তু সেই নাভিশ্বাস কাজের মধ্যেই একটু ফাঁক বার করে স্কুলে আসা, বাচ্চাদের জন্য নির্মীয়মাণ খাওয়ার ঘরের তদারকি, মিড-ডে মিল রান্নায় একটু হাত লাগিয়ে দেওয়া, কিংবা শুধুই ‘মাস্টারমশাই কেমন আছেন’ সম্ভাষণটুকু দিয়ে তাঁদের সঙ্গে নিজেদের আত্মীয় সম্পর্কটা ঝালাই করে নেওয়া।

কী দায় তাঁদের? মাস্টারমশাইয়ের কাজ পড়ানো, বাচ্চাদের কাজ পড়া, সেখানে ‘তৃতীয় পক্ষ’ কেন সময় ‘নষ্ট’ করবে? মা-বাবাদের না-হয় একটা টান আছে, তাঁদের বাচ্চারা স্কুলে পড়ছে, কিন্তু পাড়াপড়শি অন্যরা, যাঁদের বাড়িতে এমনকী কোনও বাচ্চাই নেই? এঁদের ‘ইনসেনটিভ’টা কী?

Advertisement

উত্তর পাওয়া সহজ নয়। বিশেষ, ইনসেনটিভ বা প্রোৎসাহন শব্দটাকে এমন ভাবে ব্যক্তিগত লাভ, বস্তুগত প্রাপ্তির সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয়েছে যে অন্তরের প্রেরণাটাকে আমরা দেখতে শিখি না, আমরা বলে থাকি যে, সেটাতে হৃদয় দ্রব হতে পারে, কিন্তু চিঁড়ে ভেজে না। কিন্তু আমরা না দেখলেই তো সেটা অনস্তিত্ব হয়ে যায় না। আর যায় না বলেই এই অন্তরের টানে দীর্ঘ তিন দশক ধরে ব্যক্তিগত আয়ব্যয়, লাভলোকসানের কথা না ভেবে তমিজউদ্দিন আহমেদ সাহেব এই স্কুল-আবহটাকে এমন ভাবে গড়েছেন যে ২০০৮ সালে তাঁর অবসরের পরও সেই গড়ন প্রক্রিয়া গতিভ্রষ্ট হয়নি। তাঁর উত্তরসূরি সাজেদার রহমান ও অন্যান্য শিক্ষক এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে গভীর ভাবে সঞ্চারিত এই ‘ভেতরকার তাগিদ’।

একে সহজে ব্যতিক্রমী বলে পাশে সরিয়ে রাখা যেতেই পারে, কিন্তু চোখ মেললে এমন ব্যতিক্রম চোখ এড়িয়ে যায় না। সেটাই দেখা গেল দক্ষিণ দিনাজপুরেরই কুশমণ্ডিতে। দিনটা ছিল ৫ সেপ্টেম্বর। শিক্ষক দিবস। সেই উপলক্ষে ডাক পড়েছিল একটা সভায়। সভার আয়োজক কুশমণ্ডি ও কুশমণ্ডি পূর্ব চক্রের প্রাথমিক শিক্ষকদের সমবায় সমিতি, যেটা গড়ে উঠেছিল শিক্ষকদের সঞ্চয় ও ঋণ দানের সংগঠন হিসাবে। আশ্চর্যের মনে হতে পারে, শিক্ষকদের ব্যক্তিগত স্বার্থ সুরক্ষার জন্য গঠিত এই সংস্থা ক্রমে ক্রমে চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মে লিপ্ত। সংস্থার সংগঠক উমাশংকর সরকার ও তাঁর বহু সহকর্মীর সঙ্গে আলাপ করে বাস্তবিক মুগ্ধ হতে হয় তাঁদের শুভেচ্ছার জোর দেখে। ভাদ্রের কাঠফাটা রোদ এবং অভিশাপের মতো বইতে থাকা ঘামে ভিজতে ভিজতে শোভাযাত্রা, তার পর সভা। অবাক না হয়ে পারা গেল না, সভা চলাকালীন কেউ মোবাইলে কথা বলছেন না, ঘুমিয়ে পড়ছেন না বা পাশের জনের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে সুখদুঃখের গল্প করছেন না। বেশ কয়েক জনকে দেখা গেল মন দিয়ে বক্তৃতার নোট নিতে। এ নিষ্ঠা কৃত্রিম হওয়া কঠিন, অন্তরের শুভেচ্ছা ছাড়া এতটা সংযোগ ‘বানিয়ে’ তোলার গণ-অভিনয় প্রতিভা এঁদের নেই। এর পিছনে যে প্রোৎসাহন, সেটা কি কাগজি মুদ্রার বান্ডিল থেকে অনূদিত হওয়া সম্ভব? সম্ভব যে না, সেটা তো প্রায়ই দেখতে হয়। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই কর্মপরায়ণতার চেয়ে কর্মপলায়নতা অধিক বলশালী। কিন্তু, যেটা দেখার, তা হল তোড়া-তোড়া নগদ প্রোৎসাহন যে দায়বদ্ধতাটা নিশ্চিত করতে পারে না, কেবল অন্তরের প্রেরণা সঞ্জাত সামাজিক সহযোগিতার চেয়ে অনেক বেশি কর্মপ্রসূ হয়ে ওঠে।

সেই নিষ্ঠায় উমাশংকরের মতো অনেকেই শিক্ষকের স্বল্পতা (তাঁর স্কুলে ৪৬ জন বিদ্যার্থী পিছু এক জন শিক্ষক, যা রাজ্য-গড়ের অনেক উপরে), মিড-ডে মিলে অপ্রতুল অর্থবরাদ্দ, প্রশিক্ষণগত ও পরিদর্শনগত দুর্বলতার মতো বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অবহেলার মধ্য দিয়েই কাজ করে চলেছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করে দিয়েছেন বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। বীরভূমের দক্ষিণ হরিরামপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জয়দেব ঘোষ লেগে আছেন সম্পূর্ণ জনজাতি অধ্যুষিত এই গ্রামে, শুধু স্কুলের শিশু নয়, সব গ্রামবাসীর শৌচালয় ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্যমে, উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর চক্রের শিক্ষকদের বৃহৎ একটি দল শিশুদের শিক্ষার মান বাড়িয়ে তোলার জন্য শুধু সারাদিনমান পরিশ্রমই নয়, নিষ্কুণ্ঠায় নিজেদের টাকা খরচ করে নানান কর্মকাণ্ড করে চলেছেন। সরকার হয়তো এদের স্বীকৃতি দেবে, কিন্তু যে সমস্যাগুলো সরকারের পক্ষে সহজে দূর করা সম্ভব, সেগুলো করবে না। মহত্তর এঁদের সাধনাকে কেবল অর্থমূল্যে পুরস্কৃত করে দায় সারবে, কিন্তু এই প্রেরণাগুলোকে সংহত করার কোনও উদ্যোগ নেবে না।

অর্থমূল্যের প্রোৎসাহনবাদীরা হয়তো বিশ্বাসই করবেন না যে অন্তরের প্রোৎসাহন বলে কিছু হয়। তাঁরা বলবেন এ নিছক ব্যক্তিনির্ভর আবেগ, নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়নে ধোপে টেকে না। হয়তো তা-ই, কিন্তু আবেগটাকেই বা অস্বীকার করি কী করে? কী করেই বা উপেক্ষা করি শিশুদের বিপুল উচ্ছ্বাস? পাইনালা মহাগ্রামের শিশুরা তাদের আঁকা ছবি দেখাল, ছড়া শোনাল, শিক্ষকদের শেখানো যোগাসন করে দেখাল, প্রত্যেকটার নাম বলে বলে। আমাদের তাড়া ছিল, কিন্তু তাদের দেখানোর ছিল, তারা শিখছে। অতএব, তারা গান গাইল, সমবেত সংগীত, কিন্তু ‘সত্য কথা বলব’, ‘সত্য পথে চলব’র মতো উচ্চারিত পঙ্ক্তিগুলোতে সুরমূর্ছনার চেয়ে অনেক জোরালো ভাবে ঝংকৃত হচ্ছিল এক সুষ্পষ্ট প্রতিজ্ঞা: আমরা কিছু হতে চাই, করতে চাই, যেটা পৃথিবীর জন্য শুভকর।

অর্থ দরকারি বটে, কিন্তু কেবল অন্য কিছুর জন্যই তা দরকারি অ্যারিস্টটলের এই প্রজ্ঞাকে শিশুদের প্রতিজ্ঞামুখরতার সঙ্গে যোগ করা কঠিন হতে পারে, কিন্তু কর্তব্য হিসেবে তা নির্বিকল্প।

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement