সূরয ছেত্রী। বাড়ি কালচিনি। এক বারও কলকাতা দেখেননি। দেখবার যে খুব ইচ্ছে আছে তা নয়। জিগ্যেস করলেন, ‘আপনারা এখানে কী দেখতে আসেন?’ চালসা থেকে বামনহাট প্যাসেঞ্জারে করে এসেছি রাজভাতখাওয়া। উত্তরবঙ্গের এই নিঝুম ছোট স্টেশনগুলোতে টুংটুং করে ঘণ্টা বাজলে তবেই ট্রেন আসে যায়। টিকিট কাউন্টার সারাক্ষণ খোলা থাকে না, ট্রেন যাতায়াতের খবর এলে তবে কাউন্টার খোলে। সারা দিনে একটা দুটো ট্রেন। এক্সপ্রেস পাশ দিয়ে রাজার মতো চলে যায়। ঘুরেও তাকায় না। প্ল্যাটফর্ম বাঁধানো নয় অনেক জায়গাতেই। নাবাল জমিতে নামতে হয়। দুপাশে অনেক সবুজ। জঙ্গল, চা বাগান, নিরিবিলি। কলকাতার বাঙালির রোমান্টিক মন উসকে ওঠে। দাও ফিরে সে অরণ্য না হোক, অরণ্যের দিনরাত্রি। আধুনিক সভ্যতা আর প্রযুক্তির বাইরে হাতের কাছেই পশ্চিমবঙ্গের এই ডুয়ার্স, তার সঙ্গে ইতিউতি বন্যজন্তু দেখতে পাওয়ার হাতছানি।
যাঁরা বারোমাস ডুয়ার্সবাসী তাঁরা এই রোমান্টিকতায় ডুব দিতে পারেন না। রাজাভাতখাওয়ার দেবু ঘোষ কথায় কথায় একটা হিসেব দিলেন। ভাল স্কুল সবই আলিপুরদুয়ারে। যাওয়া-আসার বাস একটা। মানুষজনকে অটোর ওপর নির্ভর করতে হয়। অটো ভাড়া এক জনের ত্রিশ টাকা। এক পিঠ। দুপিঠে তিরিশ তিরিশ ষাট। একটা ছেলে বা মেয়ের স্কুলে যেতেই কত খরচ। তার পর টিফিন। তা ছাড়া ঠিক মতো অটো না পাওয়া। ফলে শুরু করে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া পড়ুয়া অনেক। সূরয ছেত্রীর বন্ধু অমৃত ছেত্রী, আমাদের রাজাভাতখাওয়া থেকে নেপালিদের গ্রাম রাই মাটাং-এ নিয়ে যাচ্ছিলেন। গারোবস্তির একটা স্কুলে পড়াতেন। অকল্যান্ড। ইংলিশ মিডিয়াম। মাধ্যমিক নয়। সিক্স সেভেন পর্যন্ত। স্থানীয় মানুষ সেই স্কুলের ব্যয় ও বিধি সামলে উঠতে পারলেন না। ফলে এখন বাড়িটি আছে, স্কুলটি বন্ধ। গারোবস্তির দিক দিয়ে গেলে একটা নালা ডিঙিয়ে স্কুলে যেতে হয়। বর্ষায় নালার জল ফুলে ওঠে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বানানো বিশেষ কায়দার কাঠের সাঁকো ছাপিয়ে জল বয়ে যায়। যাতায়াত বন্ধ। ডুয়ার্সের গ্রাম দেখতে গিয়ে বাঙালি বাবুর ওই নালা আর সাঁকো খুব ভাল লাগে। ঘোর বর্ষায় স্কুলগামী বাচ্চাদের একটুও ভাল লাগে না। পঞ্চায়েত আছে, তাদের সাঁকো-সমস্যা দূর করার সদিচ্ছা এখনও জাগেনি। অমৃত ছেত্রী, মাস্টারমশাই থেকে এখন পর্যটকদের অটোওয়ালা। খুব হাসিখুশি। সব সময় সঙ্গে থাকে ফানি এস এম এস-এর ছোট্ট পকেট বই। অটোর পেছনে লেখা: live life before it leaves you. বন্ধু সূরয বলেন, এটা অমৃতের অটো নয়, হেলিকপ্টার।
জীবন যে কতটা কঠিন হতে পারে, টের পাওয়া গেল রাই মাটাং-এ গিয়ে। কালচিনি থেকে চাবাগানের ভেতর দিয়ে রাস্তা। নয়া বসতির হাট বসে যেখানে, তার পাশ দিয়ে এগোলে রাস্তা ফুরোবে। এর পর এক দেড় কিলোমিটার পথ রাস্তা নেই, নদীর খাত ও উপখাত। স্থানীয় লোকেরা বলেন রাই মাটাং খোলা। বর্ষা ঘন হলে এই নদীর খাত উপখাত জলে ভরে যাবে। তখন আর গ্রাম থেকে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। গ্রামের মানুষেরা তার আগেই যতটা পারেন খাবার সংগ্রহ করে নেন। গ্রামে পঞ্চাশ-বাহান্ন ঘর নেপালি পরিবার। ভুট্টা আর সুপারি। পাহাড়ের দিক থেকে রোজ প্রায় হাতি নামে। সাধের ভুট্টা খেত নষ্ট করে চলে যায়। এ গ্রামে কিশোরকিশোরীদের পাবেন না। তারা হোস্টেলে। জলবন্দি গ্রামের নবীনদের ঘরে থেকে পড়াশোনার উপায় নেই। এর মধ্যে এক দুজন এই দুর্গম রাস্তা ভেঙে যাতায়াত করে কালচিনির স্কুলে, যাতায়াতই হয়, পড়াশোনা হয় না।
বাঙালিবাবুরা রাই মাটাং-কে রায় মাটাং বলেন। শুধু কলকাতার নয়, ওখানকারও অনেকে। রাজাভাতখাওয়ার প্রাকৃতিক জাদুঘর উদ্বোধন করেছিলেন প্রয়াত সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদার। সেখানে ডুয়ার্সের কী দেখবেন কোথায় থাকবেন গোছের ছবিওয়ালা যে বই বিকোচ্ছে তাতেও গ্রামের নাম রায়মাটাং। রাইকে রায় করে নিলে বাঙালির জিভ আরাম পায়, সাহেবরাও এক কালে ভারতীয় ব্যক্তি নাম ও স্থান নামের ক্ষেত্রে এমন কাণ্ড করতেন। রাইকে রায় করে বাঙালি যে নেপালিদের কাছে টানছেন তা নয়, শুধু জিভের আরামটুকু। যেমন পর্যটকেরা জঙ্গলের আরামটুকু নেন তেমনই।
গারোবস্তির লালসিং ভুজল থেমে থেমে বাংলা বলেন। গারোবস্তিতে এখন অবশ্য গারোদের খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। ব্রিটিশ সরকার গারোদের এনে বসিয়েছিলেন, কিন্তু ম্যালেরিয়ায় গাঁ উজাড়। তখন এমন জনগোষ্ঠীর খোঁজ পড়ল যারা গোপালক। মশা গোরু-মোষকে কামড়াবে, মানুষকে কম, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমবে। লালসিং-এর পরিবার এই দফাতে আসেন, ঠাকুরদা ব্রিটিশ আমলে বন দফতরের কর্মী। লালসিং-এর বাবা আর লালসিং দুজনেই কৃষক। লালসিং ভুট্টা থেকে এখন ধানের দিকে ঝুঁকেছেন। ভুট্টার বাজার মন্দ নয় কিন্তু ভুট্টা পাকলে হাতি দল বেঁধে নামবেই। যত না খাবে তার থেকে অনেক বেশি নষ্ট করবে। তাই ধান। ধান খেতেও হাতি আসে তবে ভুট্টার তুলনায় কম। এই ধানে লালসিং-এর বছরের খোরাকি হয়ে যায়, কিচেন গার্ডেন আছে। লালসিং গড়ে তুলছেন দোতলা কাঠের বাড়ি, খানিকটা হোম স্টে ধাঁচের, বাঙালি পর্যটকদের জন্য। খোরাকির বাইরের উদ্বৃত্ত এখান থেকে উঠে আসার কথা।
লালসিং-এর সঙ্গে কথা বলে টের পাওয়া গেল, কৃষক হিসেবে তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ প্রখর। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের রাজনীতিতে অনেক দিন ধরে নানা কারণে সর্বহারার দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। যখন যে ক্ষমতায় তার সঙ্গে দুর্বৃত্তদের চমত্কার যোগাযোগ। রাজনৈতিক দলাদলি প্রধান হয়ে উঠেছে, এলাকার উন্নয়ন গৌণ। লালসিং ভুজল এই ছকের বাইরে। খবর রাখেন অনেক কিছুর। বললেন, এখানে আমরা নানা জাতি ও ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকি। ধর্ম নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাই না। তবু দেখবেন পশ্চিমবঙ্গে আস্তে আস্তে বি জে পি-র মাটি শক্ত হবে। মানুষ বিকল্প খুঁজছে। কথাটার মধ্যে চিন্তা আর বিষণ্ণতা।
সামনে লালসিং-এর খেত, এক দিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল। দূর থেকে ট্রেনের শব্দ। রাজাভাতখাওয়া স্টেশনের গায়ে বনবিভাগের বাংলো। সামনে নীল-সাদা কাপড় দিয়ে অনেকটা অংশ ঘেরা। বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলের মতো দেখায়। মুখ্যমন্ত্রী ঘুরে গেছেন। লালসিং, অমৃত, এঁরা কথা বলতে বলতে নিজেদের মধ্যে খানিক হাসাহাসি করে নিলেন। গণতন্ত্রে সব স্তরের মানুষের যে সচেতনতা দরকার, সেই সচেতনতা এঁদের আছে। কলকাতার বাঙালি ভদ্রলোকেরা ও রাজনীতিবিদরা কতটা তা টের পান জানি না। মনে মনে ওঁদের কুর্নিশ করি। অমৃতের অটোয় বসে ভাবি, উদ্যমে, উত্সাহে ওঁরা জীবনে যে লড়াই জারি রেখেছেন তা দেখার মতো জীবন ওঁদের ছেড়ে যাবে না।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক।